অতি দারিদ্র্য দূরীকরণের সর্বজনীন পদ্ধতি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দারিদ্র্য দূরীকরণে অবদানের জন্য এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন এমআইটির অর্থনীতির অধ্যাপক দম্পতি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্তার ডুফলো। ২০০৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ব্র্যাকের আল্ট্রা পুয়োর গ্র্যাজুয়েশন মডেল নিয়ে নিবিড়ভাবে গবেষণা করেছিলেন তাঁরা। ২০১৫ সালে তাঁদের গবেষণার ওপর একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’-এ। এটি সেই প্রবন্ধের একটি ভাবানুবাদ।

দরিদ্ররা যে দরিদ্র্য, তার কারণ শুধু এই নয় যে তাদের টাকা নেই। আরো নানাবিধ অভাবের কারণে তারা দরিদ্র : যেমন, অনেক মৌলিক বিষয়ে সম্যক জ্ঞান, আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধা এবং নিজেদের সক্ষমতার ওপর আস্থার অভাব। এ কারণেই ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (সংক্ষেপে এমআইটি) অর্থনীতির অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্তার ডুফলো তাঁদের ২০০৪ সালে প্রকাশিত বই ‘পুয়োর ইকোনমিকস’-এ বলেছেন, দরিদ্রদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য শুধু দক্ষতা, ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ালেই হবে না, প্রয়োজন আরো বেশি কিছু।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে অতি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়াটা কেন খুব সোজা কাজ নয়। অতি দরিদ্র বলতে তাদের বোঝানো হয়, যারা দৈনিক ১.২৫ ডলারের (২০১৯ সালের বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ১০৬ টাকা) কম আয় করেন।

দারিদ্র্য বিমোচনে যত রকম কর্মসূচি দুনিয়ায় আছে, তাতে দেখা গেছে শুধু অল্প কিছু এলাকার, অল্প কিছু মানুষ, অল্প কিছু সময়ের জন্যই উপকৃত হয়। মূল সমস্যা হলো, এসব কর্মসূচিতে যারা অংশগ্রহণ করে, শুরুতে তাদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সেই অবস্থাটা তারা ধরে রাখতে পারে না।

বেশির ভাগই কিছুদিন পরে আবার আগের অবস্থায় ফেরত যায়। যেমন ধরা যাক ক্ষুদ্র ঋণের কথা। এ ধরনের ঋণ নিয়ে শুধু তারাই উন্নতি করতে পারে, যারা ব্যক্তি হিসেবে উদ্যোগী প্রকৃতির। অতি দরিদ্রদের মধ্যে আবার এ ধরনের উদ্যোগী মানুষের সংখ্যা খুব একটা বেশি না।

একইভাবে শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ বা এ ধরনের প্রকল্পের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা। এক দেশে যেটা কাজ করেছে, অন্য দেশে আবার সেটা করেনি। এর মূল কারণ সংস্কৃতি ও পারিপার্শ্বিকতায় ভিন্নতা। এবং অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সবচেয়ে দরিদ্র যারা, তাদের অবস্থায় পরিবর্তন আনাটাই সবচেয়ে কঠিন।

সুতরাং, পুরো ছবিটা দেখে আশাহত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এই বাস্তবতায় অধ্যাপক ব্যানার্জি, অধ্যাপক ডুফলো এবং আরো কয়েকজনের লেখা অন্য আরেকটি নিবন্ধের বিষয়বস্তুকে চমকপ্রদ মনে হতে বাধ্য। তাঁদের দাবি, দারিদ্র্য দূরীকরণের এমন একটি কৌশল তাঁরা বের করেছেন, যা সব জায়গায়, সব ধরনের মানুষের জন্য কাজ করবে। গবেষণাটি করা হয়েছে সাত বছর ধরে, বিশ্বের ছয়টি দেশের প্রায় ১০ হাজার দরিদ্র পরিবারের ওপর।

এই কৌশলের অংশ হিসেবে, ওই পরিবারগুলোকে প্রথমে কিছু সম্পদ (মূলত গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি) হস্তান্তর করা হয়। এর পর তাদের দেওয়া হয় কিছু নগদ অর্থ সহায়তা। সবশেষে দুই বছর ধরে তাদের নানা রকম প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দেওয়া হয়, যাতে তারা সেই সম্পদগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। ঘানা, পাকিস্তান ও পেরুর মতো কয়েকটি দেশে দেখা গেছে যে এই ফর্মুলায় একেবারে হতদরিদ্র মানুষের জীবনে একটা দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

অতি দারিদ্র্য দূর করার এই কৌশলটির মূল প্রবক্তা বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটি এর নাম দিয়েছে ‘গ্র্যাজুয়েশন প্রগ্রাম’। এই কৌশলটির পেছনে যুক্তিটা এ রকম : একটি সমস্যা সমাধান করে, বাকি সমস্যাগুলো ফেলে রাখলে কোনো লাভ হবে না। যার শরীরে অনেক গভীর ক্ষত, তার মাত্র একটিতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বাকিগুলো ফেলে রাখলে সেগুলোতে পচন ধরবে—এটাই স্বাভাবিক।

যেমন ধরা যাক হিইফার ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফাম বা ওয়ার্ল্ড ভিশনের কথা। এই আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো অনেক উন্নয়নশীল দেশে দরিদ্রদের মাঝে গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি বিতরণ করে, যাতে তারা দুধ বা ডিম বিক্রি করে আয়-উন্নতি করতে পারে। কিন্তু যদি দরিদ্র মানুষগুলো ক্ষুধার জ্বালায় সেই গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি খেয়ে ফেলে, তখন কী হবে?

ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন প্রগ্রামেও দরিদ্রদের হাঁস-মুরগি দেওয়া হয়েছে। তবে সঙ্গে দেওয়া হয়েছে কিছু নগদ অর্থ সাহায্য, যাতে তাদের প্রথমেই সেই হাঁস-মুরগি খেয়ে ফেলার প্রয়োজন না হয়। পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে হাঁস-মুরগি পালনের ওপর প্রশিক্ষণও। এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা বারবার তাদের বাড়িতে গেছেন, নিয়মিত তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চেষ্টা করেছেন।

এমআইটির গবেষক ব্যানার্জি, ডুফলো ও তাঁদের সহযোগীরা স্থানীয় এনজিওদের সাহায্যে এই মডেলটি নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, ভারত, পাকিস্তান ও পেরুতে। সব জায়গায়ই অতি দরিদ্রদের এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। ভারতে যে পরিবারগুলো এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে, তাদের ৭৩ শতাংশ ছিল অতি দরিদ্র। ইথিওপিয়ায় ছিল ৬৬ শতাংশ। এদের সবার দৈনিক আয় ছিল ১.২৫ ডলারের কম।

এই ছয়টি জায়গাতেই দরিদ্র পরিবারগুলোকে যেকোনো একটি সম্পদ (গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি) বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এটা তাদের দেওয়া হয় এককালীন অনুদান হিসেবে। পাশাপাশি, এক বছর ধরে প্রতিদিন এক কেজি চাল কেনার জন্য যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন, তাদের সেটাও দেওয়া হয়। প্রদত্ত সম্পদ ব্যবহার করে কিভাবে আয়-রোজগার করা যায়, সে বিষয়ে তো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ই, পাশাপাশি কিভাবে এই প্রাণিগুলোকে সুস্থ রাখা যায় শেখানো হয় তা-ও।

সবশেষে আয়ের একটি অংশ কিভাবে নিরাপদে সঞ্চয় করা যায়, তাদের সেই উপায়ও বাতলে দেওয়া হয়। আর নানাভাবে উৎসাহ দেওয়ার বিষয়টি তো রয়েছেই। অবশ্য দেশভেদে কিছু কিছু ভিন্নতা ছিল। যেমন কোনো কোনো দেশে দেওয়া হয়েছে গরু-ছাগল, কোথাও বা হাঁস-মুরগি। অর্থ সঞ্চয়ের বিষয়টির ওপর কোনো দেশে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, কোনো দেশে কম। তবে মূল কর্মকৌশলটি সবখানে একই ছিল।

এই পরীক্ষার ফলাফল ছিল আশাব্যঞ্জক। কর্মসূচিগুলোর দুই বছরের মেয়াদ শেষে দেখা গেছে, অন্যদের তুলনায় অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর মাসিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে ৫ শতাংশ। তাদের পারিবারিক আয়ও বেড়েছে। রাতে খালিপেটে ঘুমাতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমেছে। সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ শতাংশ, যা দেখে বোঝা যায় যে তাদের যে হাঁস-মুরগি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো তারা খেয়ে ফেলেনি।

তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৭ মিনিট বেশি কাজ করেছে, মূলত গবাদিপশু বা হাঁস-মুরগি প্রতিপালনে। এ ক্ষেত্রে যদিও কিছু কিছু দেশে ভিন্নতা আছে, যেমন হন্ডুরাস ও পেরুতে এই সময়টা তেমন একটা বাড়েনি, আবার ইথিওপিয়ায় বেড়েছে গড় থেকে বেশি হারে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি হলো : একেবারে দরিদ্রদের মধ্যেও যারা দরিদ্রতম (অর্থাৎ একেবারে নিচের দিকের ১০ শতাংশ পরিবার), তাদের পারিবারিক ব্যয় ও সম্পদের ব্যবহারের ওপর একটা দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা গেছে।

এই গবেষকরা যখন কর্মসূচিগুলো শুরু হওয়ার এক বছর পর এই পরিবারগুলোর সদস্যদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেছেন, দেখা গেছে তখনই তাঁরা আগের চেয়ে বেশি সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করছেন, তাঁরা আগের চেয়ে বেশি আয় করছেন এবং খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে।

গবেষকরা তখন বলেছেন যে কর্মসূচিগুলো আরেকটু লম্বা সময়ের জন্য চালু রাখা গেলে বিনিয়োগের তুলনায় অন্তত ১.৩৩ থেকে ৪.৩৩ গুণ বেশি সুফল পাওয়া যেত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশের কথা, যেখানে এ রকমই আরেকটি গবেষণায় টানা তিন বছর ধরে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

এই পরীক্ষামূলক কর্মসূচিগুলোর পরিচালনা ব্যয় দেখলে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে। যেমন ভারতে প্রতি পরিবারের পেছনে খরচ হয়েছে ৪১৪ ডলার এবং পেরুতে তিন হাজার ১২২ ডলার। তবে এর অন্য দিকটি হলো, অংশগ্রহণকারীদের যেসব সহায়তা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সব এককালীন, যেখানে অন্য প্রায় সব দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা আজীবন সহায়তা পেতেই থাকেন।

সেই হিসেবে এই গ্র্যাজুয়েশন প্রগ্রাম অন্য কর্মসূচির তুলনায় কম ব্যয়বহুল। ভারতের কথাই ধরা যাক। দেশটি প্রতিবছর তাদের জিডিপির ০.৩ শতাংশ ব্যয় করে পাঁচ কোটি পরিবারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। এটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। সে তুলনায় একইসংখ্যক পরিবারের জন্য গ্র্যাজুয়েশন প্রগ্রামে দুই বছরের জন্য এককালীন ব্যয় হবে জিডিপির ১ শতাংশ।

কিছু কিছু পরিবর্তন এনে গ্র্যাজুয়েশন প্রগ্রামটি আরো কম খরচে বাস্তবায়নেরও উপায় আছে। যেমন মাঠকর্মীদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টি। পুরো কর্মসূচির সবচেয়ে ব্যয়বহুল অংশ এটি। অংশগ্রহণকারীদের সম্পদ হস্তান্তরে তুলনায় এতে খরচ হয় দিগুণ।

উগান্ডায় সম্প্রতি একই ধরনের আরেকটি গবেষণা চালানো হয়েছে। সেখানে মাঠকর্মীরা আরো ঘন ঘন বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু তাতে তেমন কোনো বাড়তি লাভ হয়নি। সুতরাং এখানে কিছু কাটছাঁটের সুযোগ আছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইটা এখন যেন আগের চেয়ে একটু কম অসম বলে মনে হচ্ছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036270618438721