অতিরিক্ত কর্তন ও কাঙ্গালের ধন চুরি

মুজম্মিল আলী |

গত দুদিন ধরে মনটা বিগড়ে আছে ৷ দৈনিক শিক্ষায় গত ১৬ এপ্রিল বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ তহবিলে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তনের সরকারি আদেশটি প্রকাশিত হয়। এরপর শুধু আমার নয়, সারা দেশের পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক কর্মচারীর মন ভালো নেই ৷ কেন জানি মনে হয়, বিষয়টি আমি বা আমরা যারা লেখালেখি করি তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি ৷ শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে যারা কাজ করেন তারাও ৷ 

অপরদিকে, সরকারের খেয়ে-পরে যে লোকগুলো ভেতরে ভেতরে শিক্ষা ও শিক্ষক বিদ্বেষী কাজ করেন; শিক্ষায় সরকারের সব সাফল্যকে ম্লান করে দিতে সর্বদা তৎপর থাকেন তারা জয়ী হয়েছেন ৷ আমি মোটেও বুঝে উঠতে পারি না কেন এরা বার বার বেসরকারি শিক্ষক সমাজকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন? দেশের ৯৫ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যারা চালিকা শক্তি তাদের ওপর বার বার বঞ্চনার খড়গ নেমে আসে কেন?  শুধু এদের দোষ দেই কী করে?

এই সেদিন দৈনিক শিক্ষায় দেখলাম কে কে যেন অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে সদস্য সচিব ও সদস্য হয়েছেন৷ আমার এখন মনে হয় শিক্ষক-বিদ্বেষীদের এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়নে এদের ভূমিকার কারণেই এরা বার বার এসব পদে মনোনয়ন পেয়ে থাকেন? তা না হলে তারা এখন একেবারে নিশ্চুপ কেন? 

কারিগরি শিক্ষকদের অতিরিক্ত কর্তন মনে হয় গত জানুয়ারি থেকে চলমান আছে ৷ সেদিন ময়মনসিংহ না কোথা থেকে কারিগরি কলেজের এক শিক্ষক ফোনে তার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে এক রকম কেঁদেই ফেলেন৷ তাকে বলি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান (অধ্যক্ষ) এবং কোনো একটি শিক্ষক সংগঠনের নেতা কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি বা সদস্য সচিব৷ তার সাথে আলাপ করে দেখতে পারেন৷ তিনি বলেন, এদের কারণেই আজ এসব হচ্ছে৷ তার কথাটি সেদিন খুব একটা বিশ্বাস করিনি৷

আজ কেন জানি বিশ্বাস করতে খুব মন চাইছে৷ আচ্ছা, দেখেন তো কারবারটা৷ ‘শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ স্লোগানে যখন বেসরকারি শিক্ষক সমাজ নতুন উদ্যম ও প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষা বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সেখানে তাদের মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের রূপকল্প বাস্তবায়নে এরা সুকৌশলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছেন৷ সরকার যদি এদের বিষয়ে সজাগ না থাকেন তবে এরা যে কোনো সময় সরকারের বারোটা বাজিয়ে দেবে৷ 

গত নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে অতিরিক্ত কর্তনের নামে সরকারকে ফেলে দেবার একটি কৌশল এরা এঁটেছিলেন৷ তাদের সে অপকৌশলটি ধরা খেয়ে যায়৷ এবার তারা আবার মরিয়া৷ যে করে হোক এজেন্ডা বাস্তবায়ন চাই৷ সব বেসরকারি শিক্ষক মরে গেলে তাদের কী? সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারলেই হলো৷ সরকার থাকলে কী আর গেলেই বা কী? সরকার থাকলেও তারা আছে আর  না থাকলেও তারা থাকে৷ কথায় বলে- Government may come and government may go but the official remain in the office. তাই এরা যে কাউকে সামান্যই কেয়ার করে৷

একজন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলে ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের নসিবে জুটেছে৷ না হয় জীবনেও তারা এগুলো পেতেন না৷ মাদার অব হিউম্যানিটি খেতাবপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা ঠিকই একদিন সব স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করবেন সে চিন্তায় অনেকের মাথা খারাপ৷ রাতে তাদের ঘুম হয় না৷ আসন্ন বাজেটে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ বোনাস ও সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া দেবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে৷ সে কারণেও তাদের মাথা নষ্ট হবার উপক্রম৷ তাই তারা উঠে পড়ে লেগেছে, যে করে হোক বেসরকারি শিক্ষকদের চিরদিন বেসরকারি করে রাখতে হবে৷ আর তাই এ মুহূর্তে অতিরিক্ত কর্তনের বিষয়টিই মোক্ষম এক হাতিয়ার৷ সে হাতিয়ারটি তারা হাতে তোলে নিয়েছেন৷

বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর এদের সর্বদা কু-নজর৷ কী করে তাদের রিক্ত করে রাখা যায় সে ধান্ধা ওদের৷ শিক্ষকদের বঞ্চিত রাখলে রাজ্যের সম্পদ বেঁচে যায় বুঝি! বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের  জাতীয়করণের দাবিটি যখন দিনে দিনে মুখ্য হয়ে ওঠেছে ঠিক তখন অতিরিক্ত কর্তনের আদেশ জাতীয়করণের মূলে কুঠারাঘাত ছাড়া আর কিছু নয়৷ শেখ হাসিনা এমনি এমনি মাদার অব হিউম্যানিটি উপাধি পাননি৷ ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা পেয়ে তার একান্ত ভালোবাসায় যখন বেসরকারি শিক্ষকসমাজ সিক্ত ও কৃতজ্ঞ ঠিক তখন অতিরিক্ত কর্তনের আদেশ জারি করে শিক্ষক-কর্মচারীদের কৃতঘ্ন করার হীন চক্রান্তটি শিক্ষকদেরই সম্মিলিত প্রয়াসে ঠেকাতে হবে৷ 

বেসরকারি শিক্ষকগণ বহু সমিতি করেছেন, সংগঠন করেছেন৷ এত সমিতি আর সংগঠন দিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয় না৷ তাই তাদের দুর্দিনে-দুঃসময়ে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে৷ বৃদ্ধ কৃষকের ছেলেদের নিয়ে একতাই বল গল্পটির চেতনায় তাদের সমৃদ্ধ হতে হবে৷ স্কুল লাইফে একটি ভাব-সম্প্রসারণ অনেকবার পড়েছি৷ সেটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত কবিতার দুটি চরণ৷ অতিরিক্ত কর্তনের আদেশ জারি হবার পর চরণ দুটি বারবার মনে পড়ছে-

‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি৷’ এর আগে আদেশটি প্রত্যাহার করে নেবার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি একান্তভাবে কামনা করি৷ বন্যার সময় সাপে নেউলে যদি এক টুকরো লাকড়ির ওপর আশ্রয় নিতে পারে তবে আপামর বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এক হয়ে দাঁড়াতে আপত্তি তো দেখি না৷ তাদের এখনই দৃঢ়ভাবে এক হয়ে দাঁড়াবার উপযুক্ত সময়৷ 

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক৷


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060629844665527