অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল আত্মসাৎ করছেন প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের (বিওটি) সদস্যরা। তারা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের কেন হিসাবও দিচ্ছেন না। সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে আর্থিক বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তা করছে না। নিজেদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের তথ্য ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় তারা নিরীক্ষা প্রতিবেদন করাচ্ছেন না; করালেও সেটি ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিচ্ছেন না। উদ্যোক্তাদের আর্থিক খাই মেটাতে বাড়াতে হচ্ছে টিউশন ফি।
আবার বিওটি সদস্যরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় শিক্ষা প্রশাসনও তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সম্প্রতি রাজধানীর ৪/৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও জমি কেনা সংক্রান্ত দুর্নীতির ঘটনা ঘটলেও এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘ঢাকার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। কারণ সরকারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারাই আইন প্রয়োগ করছেন। আবার নানাভাবে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি, অবকাঠামো ও জনবল নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছেন। উপাচার্যরা এই অশুভ তৎপরতা ঠেকাতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের টিউশন বাড়িয়ে উদ্যোক্তাদের অনৈতিক চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা বজায় রাখার স্বার্থেই অডিট রিপোর্ট নিয়মিত সরকারকে দিচ্ছি। সব প্রতিষ্ঠানেই এটি হওয়া উচিত।’
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। এর প্রায় ১৮ বছর ধরে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০’ প্রণয়ন করে সরকার। এই আইনে উপাচার্যদের যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া হলেও বিওটি সদস্যদের রাজনৈতিক ও অনৈতিক ক্ষমতার দাপটে নিজেদের সক্ষমতা দেখাতে অক্ষম উপাচার্যরা। নতুন ও পুরনো মিলে দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ১০৮টি, যার মধ্যে কেবল রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় অর্ধশত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উদ্যোক্তারা শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করছেন নিজেদের ব্যবসায়িক কাজে। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের তহবিল তছরুপ করে ব্যক্তিগত ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে খাটাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানের অর্থ বাগিয়ে নিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি মাসে অন্তত চারবারও ট্রাস্টি বোর্ডের সভা হচ্ছে। ছোটখাটো প্রয়োজনেও ঘনঘন সিন্ডিকেট সভা করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি প্রতিনিধিদের না জানিয়ে গোপনে সিন্ডিকেট সভা করছে।
এ ব্যাপারে ইউজিসি’র চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, ‘বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় আয়-ব্যয়ের হিসাব দিচ্ছে না। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আজ পর্যন্ত কোন হিসাব দেয়নি। আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বারবার প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে আসছি, এতে মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে।’
যারা আয়-ব্যয়ের হিসাব দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের সমাবর্তন আটকে দিচ্ছি; নতুন ফ্যাকাল্টির অনুমোদন দিচ্ছি না, সাবজেক্ট খুলতে দিচ্ছি না; এই ধরনের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করছি না।’
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিরীক্ষা রিপোর্ট দেয়ার তাগিদ
বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠু হিসাব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব রাহেদ হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি সম্প্রতি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী সরকার কর্তৃক মনোনীত অডিট ফার্ম দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন পরবর্তী আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) জমা দিতে হবে। আইন অনুযায়ী প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিবে।’
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (নিরীক্ষা) আহমদ শামীম আল রাজী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও বিওটি সদস্যরা নানাভাবে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ করছেন। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি থেকে বার বার নির্দেশনা দেয়ার পরেও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দেয় না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রতিষ্ঠানকে অডিট রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটি অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অডিট ফার্ম দিয়ে প্রতি অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করাতে হবে। প্রতিবেদন পরবর্তী আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিলের নির্দেশনা আছে।
আইনের ৪৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। আইনের ১৪, ২৫ ও ২৬ ধারা অনুযায়ী অর্থ কমিটি গঠন ও পরিচালনা করার কথা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থ কমিটির কোন সভা করে না। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ করেনি। যেখানে করা হয়েছে, সেখানে মালিকপক্ষের পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
পুরনোদের অধিকাংশই অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে না
ইউজিসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, নতুন ও পুরনো মিলে দেশে বর্তমানে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে পুরনো ৬০/৬৫টির মধ্যে মাত্র ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসিকে নিয়মিত অডিট রিপোর্ট জমা দিচ্ছেন।
চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি), ঢাকার মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, পুন্ডু ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাত থেকে সর্বোচ্চ ২৩ বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন সরকারের কাছে দিচ্ছে না। আদৌ হিসাব নিরীক্ষা করাচ্ছেন কী না তাও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে অবহিত করছেন না।
রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা উপেক্ষিত
দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রেক্ষাপটে গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্রপতি ১৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
আচার্যের নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়ন করতে সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। এতে ১৪টি ক্যাটাগরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট করতে বলা হয়।
ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আর্থিক কার্যক্রম ব্যাংকে পরিচালিত হয় কিনা; কেনাকাটা ও ব্যয়ের ভাউচার যাচাই; সব আয়-ব্যয় নির্দিষ্ট খাতে হয় কিনা, না হলে কবে নাগাদ চালু হবে তা নির্ধারণ করা; বিবিধ ব্যয় দেখিয়ে ব্যয়ের খাত গোপন হয় কিনা তা পরীক্ষা করা; আর্থিক লেনদেনে লেজার সংরক্ষণ না হলে কতদিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে তা নির্দিষ্ট করা এবং যারা ব্যাংক ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নগদ টাকা আদায় করছে তা ব্যাংকে জমা দেয়া হয় কিনা সেগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে নির্দেশনায়।
নির্দেশনায় আরও রয়েছে, টাকা আদায়ে ছাপানো রসিদ বইয়ের যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করা হয় কিনা- তা যাচাই করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভূমি, ইমারত, ব্যাংকের স্থায়ী আমানত, মূল্যবান যন্ত্রপাতি, যানবাহন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কেনা ও রেজিস্ট্রেশন হয় কিনা এবং না হলে কার নামে তা উল্লেখ করতে হবে। ব্যাংকের হিসাব পরিচালনাকারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ তহবিল থেকে আয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা হয় কিনা, হিসাব বিবরণীতে আয়-ব্যয় দেখানো হলে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পারফরমেন্স সম্পর্কে মন্তব্য করা ও পূর্বের কোন মন্তব্য থাকলে তার বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা এবং ভ্যাট, আইটি আর্থিক বিধি অনুযায়ী কর্তন করা হয় কিনা তা নিশ্চিত করা।
এছাড়া স্থায়ী আমানতের বিপরীতে কোন প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণ নিয়েছে কিনা- নিয়ে থাকলে ব্যক্তির নামে হয়েছে কিনা তা বের করা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৪৫ (১) অনুযায়ী প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক ব্যয়ের হিসাব ইউজিসির নির্ধারিত ফর্মে প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করা হয় কিনা তা যাচাই করার নির্দেশনা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
সূত্র: সংবাদ