অনিশ্চিয়তায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কোটি শিক্ষার্থী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজধানীর ইব্রাহীমপুরের ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেনের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. জামিল। গত মার্চ মাসের পর জামিলের পড়ালেখা একপ্রকার বন্ধই রয়েছে। প্রথম দিকে স্কুল থেকে বেতনের জন্য দু-চারবার ফোন দিলেও এখন আর কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি টিভিতে প্রচারিত ক্লাসও দেখছে না। এখন বাবার সঙ্গে মুদি দোকানেই ওর বেশির ভাগ সময় কাটে।

জামিলের বাবা মো. আসাদ বলেন, ‘আমি নিজে তেমন পড়ালেখা জানি না। আমার স্ত্রীও জানে না। সে জন্যই ছেলেকে সরকারি স্কুলে না দিয়ে কিন্ডারগার্টেনে দিয়েছি, যাতে ভালো করে পড়ালেখা শিখতে পারে। কিন্তু স্কুল বন্ধের পর থেকে ছেলের পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন দেখি কবে আবার স্কুল খোলে।’ বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, দেশের প্রায় ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থীর বেশির ভাগের অবস্থা একই। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা পুরোপুরিই পড়ালেখার বাইরে চলে গেছে। স্কুল থেকেও তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি অনেক স্কুলও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এসব স্কুলের শিশুরা কোন স্কুলে পড়ে সেটাও তাদের বলার সুযোগ নেই।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল হোসেন  বলেন, ‘যেসব কিন্ডারগার্টেন এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের শিক্ষার্থীরা বা যেসব অভিভাবক গ্রামে চলে গেছেন তাঁরা তাঁদের সন্তানদের কাছাকাছি সরকারি স্কুলে টিসি ছাড়া ভর্তি করাতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমরা এরই মধ্যে সার্কুলার জারি করেছি। আমরা চাই, সব শিক্ষার্থীই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে আসুক। আমাদের স্কুলগুলোর সেই ক্যাপাসিটি আছে।’

কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, এরই মধ্যে দেশের এক হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুল না খুললে আরো প্রায় ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাবে। তবে অনেকেই স্কুল বিক্রির নোটিশ দিলেও সেখানে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্ডারগার্টেনের ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেশির ভাগই পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ কেউ ছোটখাটো নানা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন।

এরই মধ্যে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও এইচএসসি পরীক্ষা চলতি বছর না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষাও চলতি বছর নেওয়া হবে না। এতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো আরো বেশি সমস্যায় পড়ছে। কারণ এসব স্কুলে যেহেতু নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা বেশি পড়ে, তাই পরীক্ষা না হলে কেউ আর টিউশন ফি দেবে না। আবার পরবর্তী সময়ে যখনই স্কুল খুলুক না কেন, অনেকেই টিউশন ফি দেওয়ার ভয়ে অন্য স্কুলে চলে যাবে।

রাজধানীর মাটিকাটায় স্কাইলার্ক মডেল স্কুলের শিক্ষার্থী ৪৭৫ জন। তাদের শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৪১। এই স্কুলের মো. সাফায়েত হোসেন বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির পর থেকে আর টিউশন ফি পাইনি। প্রতি মাসে ৮৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এখন এ বছর যদি কোনো পরীক্ষা না হয় তাহলে কেউ টিউশন ফি দেবে না। এমনকি শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময়ে অন্য স্কুলে গিয়ে ভর্তি হবে। এরই মধ্যে ১৩ লাখ টাকা দেনা হয়ে গেছি। আর পারছি না। এ বছর স্কুল না খুললে বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’

এই শিক্ষক বলেন, ‘মাটিকাটা এলাকার মধ্যে আমার স্কুলের সুনাম আছে। গত বছর এই স্কুল থেকে পিইসিতে ২২ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে। পাশেই অবস্থিত একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একজনও জিপিএ ৫ পায়নি। অথচ আমাদের শিক্ষকরা এখন মজুরি করে পেট চালাচ্ছেন। সরকার আমাদের কোনো ধরনের প্রণোদনা বা ঋণ কিছুই দিল না।’

রাজধানীর জুরাইনের আলমবাগের স্কলার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষার্থীসংখ্যা ১৮০ জন। এই স্কুলের জন্য ভাড়া দিতে হয় মাসে ৩০ হাজার টাকা। এই স্কুলের পরিচালক ইমন আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মার্চের পর আর টিউশন ফি পাইনি। আশা ছিল বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে স্কুল আবার চাঙ্গা হবে। এই বছর স্কুল না খুললে আমাদের পক্ষে চালিয়ে রাখাই কষ্টকর হয়ে পড়বে।’

রাজধানীর মাটিকাটার আইডিয়াল পাবলিক স্কুলের শিক্ষক নাছিমা খানম। ১০ বছর ধরে তিনি শিক্ষকতা করেন। নাছিমা খানম বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। একটি সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আরেকটি স্কুলে। ফেব্রুয়ারির পর থেকে আর বেতন পাইনি। জুলাই মাস থেকে আমাদের স্কুলটিই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন খুবই কষ্টে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। এলাকার সবাই শিক্ষক হিসেবে জানে। কারো কাছে হাতও পাততে পারছি না, আবার সংসারও চালাতে পারছি না।’

বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী  বলেন, ‘আমরা টিউশন ফি পাই না। শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছি না। ফলে শিক্ষার্থীদেরও খোঁজখবর রাখতে পারছি না। শিক্ষার্থীরা এখন টিভি ক্লাস দেখছে না, পড়ালেখাও করে না। বর্তমানে দেশের অফিস-আদালত, মার্কেট, গার্মেন্ট, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, পার্ক সর্বত্র লোক সমাগম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। কওমি মাদরাসা খুলে দেওয়া হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়ামের পরীক্ষা হচ্ছে। তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলতে সমস্যা কোথায়? যেহেতু প্রণোদনা, ঋণ কিছুই আমরা পাইনি, আবার স্কুলও খোলা হচ্ছে না। তাই আমরা বিষয়টি নিয়ে আদালতে রিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

কিন্ডারগার্টেন ও সমমান স্কুল রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব জি এম কবির রানা বলেন, ‘আর্থিক অনটনে এরই মধ্যে ১৪ জন শিক্ষক হৃদরোগ, আত্মহত্যাসহ নানা কারণে মারা গেছেন। হাজারো স্কুল ভাড়া দিতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা পেশা পরিবর্তন করেছেন। এ অবস্থায় আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতি মাসেই স্কুল খুলে দেওয়া, শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং নিজ নিজ স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল হোসেন আরো বলেন, ‘কোনো স্কুলের জন্য আলাদাভাবে কিছু ভাবার সুযোগ নেই। সব স্কুলই একসঙ্গে খুলবে। বর্তমানে টেলিভিশন ও রেডিওতে ক্লাস প্রচার হচ্ছে। আমাদের সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিচ্ছেন। তবে স্কুল খোলার পর যদি কোনো বাচ্চা স্কুলে না আসে, তাহলে তাদের বাড়ি গিয়ে সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকরা অভিভাবকদের বুঝিয়ে স্কুলে নিয়ে আসবেন। আগামী বছর থেকে আমরা উপবৃত্তি ১০০ টাকার বদলে ১৫০ টাকা, বছরের শুরুতে এক হাজার টাকা কিট অ্যালাউন্স দিব। এ ছাড়া সব স্কুলেই আমরা মিড ডে মিল (দুপুরের খাবার) চালু করব। এতে কোনো শিশুই স্কুলের বাইরে থাকবে না।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037140846252441