অপচয় বেশি মাদরাসা শিক্ষায়

রাকিব উদ্দিন |

সাধারণ স্কুল ও কলেজের তুলনায় মাদরাসা শিক্ষায় অপচয় বেশি হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষায় ব্যর্থতায় শীর্ষে এমপিওভুক্ত মাদরাসা। অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি ও জেডিসি, এসএসসি ও দাখিল এবং এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষায়ও মাদরাসায় শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। এসব পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

পাবলিক পরীক্ষা শূন্য পাস করা মাদরাসার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। শিক্ষার্থী পাস করাতে শতভাগ ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষকদের এমপিও স্থগিতের কয়েক বছর না যেতেই এমপিও ছাড় করতে নির্দেশনা দিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বিরক্ত মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও মাদরাসা অধিদফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর একেএম ছায়েফ উল্লাহ বলেন, ‘প্রতি বছরই শতভাগ ফেল করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। বোর্ডের আইনজীবীর পরামর্শে প্রথমে তাদের শোকজ (কারণ দর্শানো নোটিশ) এবং এর জবাবের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়। আমি মনে করি, শতভাগ শূন্য পাস প্রতিষ্ঠান থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’

ফেল করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে না জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘ওইসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও পাঠদানের স্বীকৃতি বাতিল এবং এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সব সুবিধা বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়। মন্ত্রণালয় সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছেও।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শহর থেকে গ্রাম-সব পর্যায়েই মানুষ সন্তানদের সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন। বিগত ৮/৯ বছরে দেশের সাধারণ শিক্ষার অবকাঠামো, পরিবেশ ও শিক্ষকদের দক্ষতাসহ বিভিন্ন সুবিধা বেড়েছে। শিক্ষায় অংশগ্রহণও বেড়েছে। কিন্তু সরকার থেকে এমপিও পাওয়া সত্ত্বেও অনেক মাদরাসায় শিক্ষার পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে না। আবার ভুয়া সনদে অনেকেই শিক্ষকতায় চাকরি পাচ্ছেন। অনিয়ম-দুর্নীতিও বেশি হচ্ছে।’

গত ১৪ অক্টোবর কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ থেকে ‘রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলাধীন ঘাষিপুর রহমানিয়া আলিম মাদরাসার আলিম স্তরের স্থগিতকৃত বেতন-ভাতার সরকারি অংশ (এমপিও) ছাড়করণ’ প্রসঙ্গে মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরকে একটি চিঠি দেয়া হয়।

চিঠিতে বলা হয়, ‘ঘাষিপুর রহমানিয়া আলিম মাদরাসা মাদরাসাটির ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে আলিম পরীক্ষায় কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ও ফলাফল অর্জন করায় মাদরাসাটির আলিম স্তরের প্রভাষকগণের স্থগিতকৃত বেতনভাতার সরকারি অংশ বকেয়া ব্যতিত নিম্নোক্ত শর্তে ছাড়করণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

শর্তটি হলো- ‘আগামী ২০১৯ ও ২০২০ খ্রিস্টাব্দে কাম্যসংখ্যক পরীক্ষার্থী না থাকলে এবং ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হলে বেতনভাতাদি পুনঃস্থগিত করা হবে।’

এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ থেকে ‘বকেয়া ব্যতীত স্থগিতকৃত বেতন ভাতা ছাড়করণ’ সংক্রান্ত মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরকে একটি চিঠি দেয়া হয়।

এই চিঠিতে বলা হয়, ‘রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলাধীন আরাজী গংগারামপুর বালিকা দাখিল মাদরাসার শিক্ষকদের বেতনভাতার সরকারি অংশ বন্ধ করা হয়েছিল। চলতি ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে দাখিল পরীক্ষায় কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ও ফলাফল অর্জন করায় মাদরাসাটির পূর্বের ৯ জন শিক্ষকের স্থগিতকৃত বেতনভাতা নিম্নোক্ত শর্তে ছাড়করণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

শর্তগুলো হলো- ‘আগামী ২০১৯ ও ২০২০ খ্রিস্টাব্দে কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ও ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হলে বেতন ভাতাদি পুনঃস্থগিত করা হবে; চলতি মাস হতে এ আদেশ কার্যকর হবে। কোন বকেয়া বেতন ভাতাদি কাম্য হবে না। ‘মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গড়ে প্রতিটি এমপিওভুক্ত মাদরাসার শিক্ষকদের বেতনভাতা বাবদ মাসে সরকারি প্রায় আড়াই লাখ টাকা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু যথাযথ তদারকির অভাব, দক্ষ শিক্ষক না থাকা ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে না। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নিতে পারছে না সরকারি প্রশাসন।

ব্যর্থ মাদরাসার চিত্র

এ বছর (গত ৬ মে প্রকাশিত) এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় মোট ১০৯টি প্রতিষ্ঠানের একজনও পাস করেনি। এর মধ্যে সাধারণ আট বোর্ডের অধীন হাইস্কুল ১৩টি (এমপিওভুক্ত ২/৩টি) এবং মাদরাসা বোর্ডের অধীন দাখিল মাদরাসা ৯৬টি।

শতভাগ ব্যর্থ এসব মাদরাসার ১৯টিই এমপিওভুক্ত। সৃষ্ট পদ অনুযায়ী প্রতিটি দাখিল মাদরাসায় নূূূ্যূনতম ১৬ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন। এর বাইরেও অতিরিক্ত শ্রেণী শিক্ষক আছেন, যাদের নিয়োগ দিয়েছে পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা। তারা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকেই বেতনভাতা পাচ্ছেন।

২০১৭ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি ও সমমানের দাখিল পরীক্ষায় ৮টি শিক্ষা বোর্ডের ৯৩টি প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীই পাস কারেনি, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদরাসা বোর্ডের ৮২টি। এই ৮২টি প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটি ছিল এমপিওভুক্ত।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অধিকাংশ মাদরাসার অনুমোদন, স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তি করা হয়েছে। এসব অনিয়মের পেছনে মূলত দায়ী শিক্ষা প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা।

২০১৭ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় ৫৯টি প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি, যার মধ্যে ২৫টিই মাদরাসা বোর্ডের। এর মধ্যে একটি মাদরাসা এমপিওভুক্ত। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ও জেডিসিতে ২০টি মাদরাসায় কেউ পাস করতে পারেনি, যার মধ্যে তিনটি ছিল এমপিওভুক্ত।

জানা গেছে, অষ্টম শ্রেণী সমমানের জুনিয়র দাখিল পরীক্ষায় শূন্য পাস করা পাঁচটি এমপিওভুক্ত মাদরাসার একাডেমিক স্বীকৃতি এ বছর বাতিল করেছে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড। এরপর মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধের সুপারিশ করে গত জুনে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে চিঠি দেয়। মাদরাসা বোর্ডের নির্দেশনায় বলা হয়, শতভাগ শূন্য পাস করা পাঁচ মাদরাসার স্বীকৃতি ও এমপিও সাময়িকভাবে স্থগিতের সুপারিশ করা হলো।

মাদরাসাগুলো হলো- ঝালকাঠির সদর উপজেলার মোকাররমপুর দরবার শরীফ দাখিল মাদরাসা ও নলছিটির দক্ষিণ খাওক্ষির মেহেদিয়া দাখিল মাদরাসা, কুমিল্লার সদর উপজেলার শাহে মদিনা হরমুজের নেছা আমতলী দাখিল মাদরাসা ও বরুড়া উপজেলার আগানগর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা এবং ভোলা চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ ওসমানগঞ্জ মোজাফফরিয়া দাখিল মাদরাসা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ২৬ হাজার ৮১টি সাধারণ স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা এবং ৭৭৫টি কারিগরি কলেজসহ প্রায় ২৮ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিও সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের এমপিও বাবদ প্রতি মাসে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৯৪০ কোটি ৪৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

বর্তমানে দেশে মাদরাসার জুনিয়র দাখিল থেকে কামিল (ষষ্ঠ থেকে স্নাতকোত্তর) পর্যন্ত মোট এমপিওভুক্ত মাদরাসা আছে সাত হাজার ৬১০টি। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত জুনিয়র দাখিল মাদরাসা (ষষ্ট থেকে দশম শ্রেণী) পাঁচ হাজার ৩৭১টি। এসব মাদরাসায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ৭১ হাজার।

আর দেশে এমপিওভুক্ত দাখিল মাদরাসা রয়েছে ৯৮২টি। এসব মাদরাসায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি।

আলিম মাদরাসা (এইচএসসি সমমান) রয়েছে এক হাজার ১১২টি এবং দেশে এমপিওভুক্ত ফাজিল ও কামিল মাদরাসা (মাস্টার্স/স্নাতকোত্তর) রয়েছে ১৪৫টি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাত হাজারেরও বেশি শিক্ষক আছেন।

সবমিলিয়ে এমপিওভুক্ত মাদরাসায় মোট শিক্ষক আছেন এক লাখ ২০ হাজার এবং কর্মচারী আছে প্রায় ৪০ হাজার। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য প্রতি মাসে সরকারের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

এছাড়াও এমপিওভুক্ত পশ্চম শ্রেণী সমমানের স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসা (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী) রয়েছে এক হাজার ৫১৯টি। এমপিওভুক্ত এসব মাদরাসায় শিক্ষক রয়েছেন চার হাজার ৪৩১ জন।

 

সূত্র: দৈনিক সংবাদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047621726989746