শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। দুনিয়াতে আর এমন একটি পেশা নেই যা সম্মানের দিক থেকে শিক্ষকতা পেশার সমান। শিক্ষকরা সোনার মানুষ গড়ার কারিগর। একটি দেশ, জাতি ও সমাজ তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, দক্ষতা ও নৈতিকতা বোধ নিয়ে গড়ে তুলতে চান, সে কাজটা সম্পন্ন করেন শিক্ষকরাই।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার ও জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার অধিকার পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হলে জনসাধারণের অন্যান্য অধিকার আদায়ের পথ সুগম হবে। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমাদের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত পায়নি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষাকে মৌলিক নীতিমালা হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
এগুলো সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার দিক নির্দেশনা দেয়। শিক্ষা মৌলিক অধিকার না হওয়ার কারণে মৌলিক নীতিমালা লঙ্ঘনের দায়ে রাষ্ট্র বা সরকারকে আইনত বাধ্য করা যায় না বা তার বিরুদ্ধে মামলাও করা যায় না। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ অর্থাৎ হেফাজত করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের, যা সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এবং এই মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ১০২(১) বিধান মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা করতে পারবে। আইনগত অধিকার না থাকায় বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মত পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, শিক্ষা ভাতা, পাহাড়িয়া অঞ্চলে চাকরিরত শিক্ষকদের জন্য পাহাড়ী ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এটি একেবারেই অনভিপ্রেত।
বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগ এবং পর্যাপ্ত সমর্থন না থাকায় তারা সর্বদাই বঞ্চিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যায় বেসরকারি শিক্ষকরা বাড়িভাড়া পান ১০০০ টাকা। বাড়িভাড়া তো দূরের কথা, বাড়ির বারান্দাও ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। তা নিতান্তই অপ্রতুল এবং উৎসব ভাতা পান স্ব স্ব স্কেলের ২৫ ভাগ। পুরো চাকরি জীবনে মাত্র একটি ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন, যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পদোন্নতির কোন ব্যবস্থা নেই। যেমন বেসরকারি কলেজে এমন অনেক মেধাবী শিক্ষক/শিক্ষিকা আছেন, যারা এসএসসি থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যন্ত অনেক বিষয়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত এবং তাদের অনেকেই আবার এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী হয়েও পদোন্নতিতে অনুপাত থাকার কারণে সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না।
তাদের এত উচ্চ মানের ডিগ্রি থাকার পরও ট্র্যাজেডিটা হলো তাঁদের অনেক হতভাগ্য শিক্ষক, যাদের পুরো চাকরি জীবনটাই প্রভাষক হিসেবে কাটিয়ে দিতে হয়। বেসরকারি কলেজে পদোন্নতির কোন ব্যবস্থা না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন এই সম্মানজনক পেশায় আসতে চরম অনীহা প্রকাশ করেন।পৃথিবীর কোন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এমন তুঘলকি প্রথা আছে বলে আমাদের জানা নেই।
আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষক সমাজের ন্যায্য পাওনা সুনিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি ও ভাষাগতভাবে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। আর এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাস্তবায়িত করবেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরাই।
তাই এই পাঁচ লাখ বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে কখনোই সরকারের এই মহৎ উদ্দেশ্য সফল হবে না। বেসরকারি শিক্ষকদের উপর্যুক্ত যৌক্তিক দাবি গুলো বর্তমান সরকার পূরণ না করলে তাঁরা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়বেন, রাষ্ট্র এবং সমাজে সকল পেশার মানুষের নিকট হেয় প্রতিপন্ন হবেন, তার ফলস্বরূপ তারা ক্লাসে ঠিকমত মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করতে পারবেন না। তাহলে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।
তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনার কাছে ৫ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলো, যেমন সরকার ঘোষিত বাজেট প্রণয়নের সময় ন্যায্য প্রাপ্য বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মত পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, শিক্ষা ভাতা, পাহাড়িয়া অঞ্চলে চাকরিরত শিক্ষকদের জন্য পাহাড়ী ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়ার অনুরোধ জানাই।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, দালাল বাজার ডিগ্রি কলেজ, সদর, লক্ষ্মীপুর।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]