অভিভাবকবিহীন প্রাথমিকের ৮ম শ্রেণি

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

অষ্টম শ্রেণি দেখভালের দায়িত্ব প্রাথমিকের না মাধ্যমিকের বিষয়টি নিয়ে আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর ছিল চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পঞ্চাশের দশকে তা ৫ম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শরিফ কমিশন, ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কুদরত-ই-খুদা কমিশন, সর্বশেষ কবীর চৌধুরী কমিশনসহ সব কমিশনই প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। সর্বশেষ কবীর চৌধুরী কমিশনের সিদ্ধান্ত ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখতে শুরু করে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিটি উপজেলায় জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে কমপক্ষে ১টি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। এ প্রেক্ষিতে বেশ কিছু স্কুলকে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি চালুর অনুমতি দেয়া হয়। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে কিছু বিদ্যালয়কে দেয়া হয়েছে ইআইআইএন নম্বরও। 

এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব শিক্ষার্থীকে জেএসসির রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত সভা ডাকলেও পরে তা স্থগিত করেছে। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার কারিকুলাম প্রস্তুতির কথা শোনা গেলেও সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। প্রাথমিকে ৫ম শ্রেণিতে ৬টি বই। অথচ ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এক লাফে বইয়ের সংখ্যা বেড়ে হয় ১৪টি। ভাবখানা এমন, প্রাথমিক সমাপনীতে পাস করে শিশু শিক্ষার্থী যুবকে পরিণত হয়েছে।

শিশু শিক্ষার একমাত্র মন্ত্রণালয় হলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিশুরা সবার ভালোবাসার পাত্র। দেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি গল্পের অবতারণা করছি।

জমিদার বাড়ির কুয়ায় একটি শিশু পড়ে গেছে। সবার ধারণা কুয়ায় কাজের মেয়ের ছেলে পড়েছে। ছেলেকে কুয়া থেকে তোলার আকুতিতে মায়ের কান্নায় ও বিলাপে এক মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জমিদার তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে উপস্থিত হয়ে শিশুটিকে উদ্ধারের ব্যবস্থা না করে কাজের মেয়েকে তিরস্কার করতে করতে চাকরিচ্যুতির আদেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জানাজানি হলো জমিদারের নিজের সন্তান কুয়ায় পড়েছে। জমিদার তাৎক্ষণিক নিজের সন্তানকে কুয়া থেকে উদ্ধার করেন। আর কাজের মেয়ে চাকরিচ্যুতি তুচ্ছ ভেবে ও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে নিজের শিশুকে মায়ায় জড়িয়ে জমিদার বাড়ি ত্যাগ করেন। শিশুর প্রতি এ ভালোবাসার নিদারুণ বৈষম্য সর্বস্তরের। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষক সমাজের মাঝেও দৃশ্যমান।

মাননীয় গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে তৃণমূলে শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষ করে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের  সচিব। One Day One Word কার্যক্রমে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ভাষাগত জ্ঞান অর্জনে সাফল্য লক্ষ করা গেছে। সব শিশুর প্রতি ভালোবাসার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে অভিন্ন কর্মঘণ্টা, পাঠ্যবই, মূল্যায়ন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। ঠিক তেমনি শিশু শিক্ষায় বৈষম্য কর্মঘণ্টা কমানো, সকল শিশুর অভিন্ন পাঠ্যবই, আদর্শ মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ায় আশ্বাস না দিয়ে দ্রুত কার্যকরের ব্যবস্থা নিন।

৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ১৪টি করে ৩টি শ্রেণিতে বিষয়ের সংখ্যা ৪২টি। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৪২টি বিষয়ের শ্রেণির কার্যক্রম চালানোর চ্যালেঞ্জ দূর করার অভিপ্রায়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে দৃশ্যমান নয়।

শিক্ষার উন্নয়নে একজন নিরলস কর্মী ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য (সাংগঠনিক) মো. সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে ৩  সদস্য বিশিষ্ট এক প্রতিনিধি দল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালুকৃত বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের অসহায়ত্ব দূরীকরণে ২৩ দফা সুপারিশ পেশ করেন।

বর্ণিত দাবিসমূহ:
* নতুন শিক্ষক পদ সৃষ্টি। 
* নতুন ভবন বা শ্রেণিকক্ষ তৈরি। 
* ICT সহ বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা (মাধ্যমিক পর্যায়ে)। 
* শিক্ষার্থী অনুযায়ী উঁচু ও নিচু বেঞ্চ প্রদান। 
* আসবাবপত্র প্রদান। 
* বিজ্ঞানাগার স্থাপন। 
* ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির জন্য স্কুল কন্টিজেন্সির বরাদ্দ। 
* বই বহনের ব্যবস্থা গ্রহণ। 
* ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণির বৃত্তির বিল পাস করানোর জন্য জেলা শিক্ষা অফিসে যাওয়া-আসার বরাদ্দ প্রদান। 
* বছরে কয়েকবার শিক্ষা বোর্ড যেতে হয়, তার জন্য যাতায়ত ভাতা প্রদান। 
* মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের ১২টি মাসিক সমন্বয় সভায় যাওয়ার যাতায়ত ভাতা প্রদান। 
* মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাবতীয় তথ্য প্রেরণের জন্য বরাদ্দ প্রদান। 
* ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ প্রদান।  
* ৮ম শ্রেণিকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেডে নির্ধারণ করা। 
* ৮ম শ্রেণিকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেডে নির্ধারণ করা। 
* জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষক, নিরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক ৮ম শ্রেণি চালুকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ। 
* শীতকালীন ও গ্রীস্মকালীন খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সুযোগ ও বরাদ্দ প্রদান। 
* বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাকরণ ও বরাদ্দ প্রদান। 
* ৮ম শ্রেণি চালুকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবেদন ছাড়া বদলি বা সমন্বয় বদলি করা যাবে না। 
* ৮ম শ্রেণি চালুকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান ও উপজেলার সকল কমিটিতে তাদের অন্তর্ভুক্তকরণ। 
* প্রতিটি ৮ম শ্রেণি চালুকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি। 
* প্রতিটি ৮ম শ্রেণি চালুকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন অফিস সহকারী ও আয়া নিয়োগ। 
* প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের জন্য আলাদা অফিস কক্ষ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কমনরুম নির্মাণ।

৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির বিদ্যালয়গুলোর চ্যালেঞ্জ দূরীকরণে আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখার প্রত্যাশা করছি।

লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064449310302734