অর্থাভাব-অনাহার দমাতে পারেনি মেধাবী ছাত্র ইমরানকে

নীলফামারী প্রতিনিধি |

বাবা নেই। মা কাজ করেন গৃহকর্মী হিসেবে। সংসারে অর্থাভাব-অনাহার নিত্যদিনের চিত্র। এর পরও থেমে থাকেনি ইমরান আলী। সব বাধা ডিঙ্গিয়ে সফলতার মুখ দেখেছে সে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে।

গত সোমবার এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সহপাঠীদের চলছিল বাঁধ ভাঙা উল্লাস। কিন্তু সেখানে অনুপস্থিত ইমরান। বাড়ির গাভীর জন্য তখন সে ঘাস কাটছিল। দেশি ওই গাভীই ইমরানের পরিবারের একমাত্র অস্থাবর সম্পদ। গাভীর দুধ বিক্রির অর্থ কিছুটা জোগান দিচ্ছে সংসারে।

সেদিন বন্ধুদের কাছ থেকে খবর পেয়ে দুপুর ২টার দিকে ইমরান ছুটে আসে বিদ্যালয়ে। ততক্ষণে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ প্রায় শূন্য। বন্ধুদের সঙ্গে ভালো ফলের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারেনি সে। দারিদ্র্যতা তাকে বঞ্চিত করল এ আনন্দ থেকে।

দুই বছর বয়সে বাবা আব্দুল জব্বারকে হারিয়েছে ইমরান। তখন দুই সন্তানকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তার মা শামসুন নাহার (৫০)। অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে পড়াচ্ছেন এক ছেলে, এক মেয়েকে। বড় সন্তান তাছকিনা খাতুন মানবিক বিভাগে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে নীলফামারী সরকারি কলেজে।

ইমরানদের বাড়ি জেলা সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের কানিয়াল খাতা গ্রামে। গতকাল দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে ভাঙা ঘর। একটি মাত্র শোয়ার ঘরে দুটি বিছানা পাতানো। একটিতে থাকে ইমরান। অন্যটিতে থাকেন মা শামছুন নাহার ও কলেজে পড়া একমাত্র বোন তাছকিনা খাতুন।

মা শামছুন নাহার বলেন, ‘ছোটবেলায় ওদের বাবা মারা গেছেন, সেই থেকে বাচ্চাদের ভালো খাওয়াতে পারি না, নতুন জামা-কাপড় দিতে পারি না। মানুষের দেওয়া পুরাতন কাপড় দিয়ে অনেক কষ্টে ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের বাড়িতে কাজ করে (গৃহকর্মীর) যেটুকু পাই, তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে তাদের লেখাপড়ার জোগান দিচ্ছি। এখন বড় হচ্ছে, তাদের পেছনে খরচও বাড়ছে। বয়সের ভারে আগের মতো কাজ করতে পারছি না।’ 

ইমরান জানায়, মায়ের আগ্রহে খেয়ে না খেয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয় সে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ হয় নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ সময় এগিয়ে আসেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাঁরা বিনা বেতনে ইমরানকে পড়ার সুযোগ করে দেন। সহযোগিতা করেছেন বই-পুস্তক দিয়ে।

বিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্য তাছকিনাকে একটি বাইসাইকেল দিয়েছিলেন বোনের নীলফামারী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। সেই সাইকেলে চেপে বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটারের পথ অতিক্রম করে শিক্ষালয়ে যেত দুই ভাই-বোন। এরপর অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে তিন হাজার টাকায় নিজের জন্য বাইসাইকেল কেনে ইমরান। সেই বাইসাইকেল হয়ে ওঠে তার বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার সঙ্গী।

ইমরান বলে, ‘স্যারেরা আমাকে প্রাইভেট পড়িয়েছে বিনা বেতনে। সহযোগিতা করেছে বই-খাতা দিয়ে। স্কুলের ম্যাডামরা কিনে দিয়েছেন জামা-কাপড়। মিটিয়েছেন স্কুলের বেতনসহ পরীক্ষার ফি। তাই দিয়ে আমার পথচলা।’

দারিদ্র্যতার সঙ্গে প্রতিদিনের লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করে ইমরান বলে, ‘বেশির ভাগ দিন কেটেছে সকালে একমুঠো পান্তা ভাত আর স্কুলের টিফিন খেয়ে। আবার কখনো না খেয়ে যেতে হয়েছে স্কুলে। বন্ধুরা অনেকে বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে যেত স্কুলে। আমার তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।’

ছোটবেলা থেকে ইমরানের স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। ওই স্বপ্নে এগিয়েছে বড় একটি ধাপ। স্বপ্ন পূরণে এখন ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা তার। কিন্তু সে ইচ্ছা স্বপ্ন পূরণে বড় বাধা পরিবারের অসচ্ছলতা।

প্রতিবেশী শিউলি বেগম (৪০) বলেন, ‘পরিবারটি অসহায়, ছেলে-মেয়ে দুটিই কষ্ট করে লেখাপড়া করছে, ভালো ফলও করছে। দেখে ভালো লাগছে। আমরা সাধ্যমতো তাদের সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করি।’

নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম রাব্বানী বলেন, ছেলেটা খুবই মেধাবী এবং সৎ। দরিদ্র পরিবারের এ মেধাবী ছাত্র শিক্ষকদের সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হলো। সহযোগিতা পেলে তার লক্ষ্যে পৌঁছবেই এক দিন।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048561096191406