অসহায় মিন্নির পাশে কেউ নেই!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁর স্ত্রী মিন্নিকে জড়ানোর সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু মিন্নিকে গ্রেপ্তার করাই বাকি। ব্যাপারটা সেদিকেই গড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। চারদিকে ছড়ানো জাল গুটিয়ে আনা হচ্ছে। মিন্নির শ্বশুর ও শাশুড়িকে দিয়েও বলানো হয়েছে, ‘মিন্নি রিফাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত’। একেই বলে প্রভাবশালী। ক্ষমতা থাকলে কি না করা যায়! রাতকে দিন, দিনকে রাত করা কোনো ব্যাপারই না। এই তো আমাদের আইনের শাসন! টাকা আর ক্ষমতার কাছে সবই যেন জিম্মি। বুধবার (১৭ জুলাই) কালের কণ্ঠে প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন মোস্তফা কামাল।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ক্ষমতা এবং অর্থবিত্তের সঙ্গেই সবাই থাকে। অসহায় কিংবা দরিদ্রের পাশে কেউ দাঁড়ায় না, কেউ থাকে না। গণমাধ্যম ছাড়া মিন্নির পাশেও কেউ নেই। নেই কোনো প্রভাবশালী কিংবা কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। কোনো নারী সংগঠনকেও দেখলাম না একটা বিবৃতি দিতে। অথচ কত আলতু-ফালতু ইস্যুতে দেখি বিবৃতির ঢল নামে। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে কি তাহলে পচন ধরল! অসহায়ের পাশে কেউ দাঁড়াবে না? আমাদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল উচ্চ আদালত কি মিন্নির ব্যাপারে কোনো সুয়োমটো রুল জারি করতে পারেন? মহামান্য আদালতের যদি কৃপা হয়!

আমরা জানতে পারলাম, মিন্নিকে রিফাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়ানোর জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা ঢালা হয়েছে। বরগুনার সব সাংবাদিককে কেনা হয়েছে। কেনা হয়েছে পুলিশ প্রশাসনকেও। এখন শুধু নাটকের শেষ দৃশ্য দেখার অপেক্ষা। টাকা এবং ক্ষমতার কাছে মানুষ যে বিক্রি হয়ে যায় তার প্রমাণ রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এখন রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি নিয়ে স্রেফ একটি নাটক তৈরি হচ্ছে।

সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি লিখেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী দুই ব্যক্তি। নাটকের প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখলাম, ১৩ জুলাই এমপির ছেলে সুনাম দেবনাথ বরগুনা প্রেস ক্লাবে এসেছেন। রিফাতের বাবাকে প্রেস ক্লাবে আনা হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলার জন্য। তিনি যখন সংবাদ সম্মেলন করছিলেন তখন সুনাম দেবনাথ প্রেস ক্লাবের ভেতরে-বাইরে যাওয়া-আসা করছিলেন। কেন তিনি প্রেস ক্লাবে গেলেন? তাঁর মিশন কী ছিল?

পরের দৃশ্যে (১৪ জুলাই) দেখলাম, মিন্নিকে ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন। প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, মিন্নির ফাঁসি চাই’। বাহ! যাঁর স্বামীকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো তাঁরই আবার ফাঁসি চাওয়া হচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে। সেই মানববন্ধনে যোগ দিয়েছেন এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ। বিষয়টা বুঝতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মিন্নিকে ফাঁসাতে সুনাম দেবনাথ কেন এত তৎপর! হঠাৎ কেন তিনি মিন্নির ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলেন? অথচ যারা প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাতকে হত্যা করল তাদের ব্যাপারে তিনি নিশ্চুপ! কিছুই বলছেন না। কেন তিনি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করছেন না?

সুনাম দেবনাথ আমাদের প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, রিফাত তাঁর রাজনৈতিক কর্মী। নির্বাচনের সময় অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সেই খুনের ঘটনায় মিন্নিই দায়ী। তাই তিনি প্রকৃত আসামির ফাঁসির দাবি করছেন। আর যারা প্রকাশে কুপিয়ে হত্যা করেছে তাদের ব্যাপারে সুনাম দেবনাথের কোনো বক্তব্য নেই! তিনি পুরোপুরি নিশ্চুপ!

আমরা জানতে পেরেছি, সুনাম দেবনাথের ফেসবুকে অনেক ‘ফেক অ্যাকাউন্ট’ রয়েছে। সেগুলো থেকে এবং তাঁর বন্ধুদের অ্যাকাউন্ট থেকে মিন্নির বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে। তাঁকে চরিত্রহীন বানাতে যা যা করা দরকার, বলা দরকার—তা-ই হচ্ছে। এগুলো পুলিশ আমলে নিচ্ছে না কেন তা বুঝতে পারছি না। পুলিশ আমলে নিচ্ছে নয়নের সঙ্গে মিন্নির সম্পর্কের বিষয়টি।

ধরে নিলাম মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের সম্পর্ক ছিল। তার বাসায় যাতায়াত ছিল। নয়নের সঙ্গে মিন্নির এই সম্পর্ক কি হঠাৎ তৈরি হলো? নাকি আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল? আবার বলা হচ্ছে, নয়নের সঙ্গে তাঁর বিয়েও হয়েছিল। কাবিননামার কাগজপত্র পত্রিকা অফিসেও সরবরাহ করা হয়। কারা উপযাচক হয়ে পত্রিকা-টিভি অফিসগুলোতে কাবিননামা সরবরাহ করল? নিশ্চয়ই এ কাজ নয়ন বন্ডের নয়?

বিয়ের ঘটনাটিও যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে কী করে মিন্নি দ্বিতীয় বিয়ে করল? তখন প্রভাবশালীদের হাত কোথায় ছিল? রিফাত যে মিন্নির স্ত্রী, এটা পরিবার-সমাজ সবাই জানে। নয়নও যে মিন্নির স্বামী, এটা কি সবাই আগে থেকে জানত? হত্যাকাণ্ড ঘটার পর এসব প্রকাশ করা হলো কেন? নিশ্চয়ই কারো স্বার্থ রক্ষার জন্য!

আমাদের প্রতিনিধিদের কাছে তথ্য আছে এবং আমি বিশ্বাস করি পুলিশের কাছেও আছে। প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় নয়ন বন্ডরা বরগুনার পুরো মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকার মাদক কারবার পরিচালিত হতো। টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল দুই গ্রুপের। মাদক কারবারের একটা বড় অংশ যেত প্রভাবশালীদের পকেটে। আরেকটি ভাগ যেত পুলিশ প্রশাসনের হাতে। বাকিটা নয়ন বন্ডরা ভাগ-বাটোয়ারা করত। দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরেই মূলত খুন হয় রিফাত।  

সংগত কারণেই শুরু থেকে মিন্নিকে ফাঁসানো কিংবা মামলাটিকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য একধরনের অশুভ পাঁয়তারা আমরা লক্ষ করে আসছি। স্থানীয় সাংবাদিকরা বারবারই বলার চেষ্টা করেছেন, মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের প্রেম ছিল। তাঁদের বিয়েও হয়েছিল। তাতে কি খুনের অপরাধ মাফ হয়ে যায়! এরপর একটি ভিডিও ছাড়া হয়। এসব করে এমন একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় যে মিন্নিই নয়ন বন্ডদের দিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে।

গণমাধ্যম বিষয়টিকে চেপে ধরার পর পুলিশ তৎপর হলেও অপপ্রচার বন্ধ হয়নি। এখনো মিন্নিকে ফাঁসানোর জন্য অপতৎপরতা চলছে। পুলিশ মিন্নিকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। এরপর পুলিশ হয়তো বলবে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা মিন্নি স্বীকার করেছে!

পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করেনি। অথচ প্রধান সাক্ষীকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে। সাক্ষী যা বলার তা আদালতেই বলবেন। আর মামলার তদন্ত যথাযথভাবে করার জন্য পুলিশ অবশ্যই মিন্নির সঙ্গে কথা বলবে। প্রথম দিকেই মিন্নির বক্তব্য রেকর্ড করে এনেছে। ১৬ জুলাই দুই দফায় কেন মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হলো? পুলিশ কি ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো কথা আদায় করার চেষ্টা করছে? 

মিন্নির সঙ্গে নয়নের প্রেমের সম্পর্ক যদি থাকেও সেখানেই তাঁকে বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। মিন্নি হয়তো ভেবেছে, নয়নকে বিয়ে করলে সে সুখী হবে না। কিংবা মিন্নি এ-ও ভাবতে পারেন, নয়ন একটা সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি। সে জেলও খেটেছে। প্রেম হওয়ার আগে হয়তো তিনি জানতেন না। জানার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নয়নকে বিয়ে করবেন না। তাই তিনি অন্য একজনকে (রিফাত শরীফ) বিয়ে করেছেন। সেই বিয়ের বয়সও বেশিদিন হয়নি। মাত্র দুই মাস! এই অল্প সময়ে ওঁদের মধ্যে কী এমন ঘটল যে নতুন বিয়ে করা স্বামীকে লোক দিয়ে খুন করাতে হবে? তাও আবার নিজে উপস্থিত থেকে!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেখছি, মিন্নিকে নিয়ে নানা রকম লেখালেখি হচ্ছে। তাঁর চরিত্র হনন করা হচ্ছে। তাঁর মতো খারাপ মেয়ে নাকি দুনিয়াতে নাই। মিন্নিকে মানসিকভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে। বারবার তাঁর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এখন আবার পুরনো গল্প নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। নয়নের মাকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, নয়নের সঙ্গে মিন্নির বিয়ে হয়েছিল। মিন্নি নিয়মিত নয়নের বাসায় যাতায়াত করত। সেখানে নাকি মিন্নির জামা-কাপড়, আয়না চিরুনিও পাওয়া গেছে। সেই খবর পেয়েই নাকি পুলিশ মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে।

পুলিশ স্বাধীন এবং সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করুক। সেখানে কোনো রকম প্রভাব বিস্তার কিংবা অর্থ বিনিয়োগ করা চলবে না। আসল সত্য বেরিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া হোক। আমরা কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, মামলাটি তার নিজস্ব গতিতে চলবে? 

মিন্নির পাশে প্রভাবশালী কেউ থাকলে কি এমন টানাহেঁচড়া পুলিশ করতে পারত? আমাদের দেশের সামাজিক সংগঠন, নারী সংগঠনগুলো এখন নিশ্চুপ কেন? তারা টুঁ শব্দটিও করছে না কেন? কেন একটা বিবৃতিও দিতে সাহস পাচ্ছে না। মেয়েটি অসহায় বলে? দুঃখজনক, সত্যিই দুঃখজনক ঘটনা!

গল্প বানালে যা খুশি তা বানানো যায়। কিন্তু আষাঢ়ে গল্পকে সত্য ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে গেলেই মানুষের চোখে ধরা পড়ে। ক্ষমতা এবং বিত্তের প্রভাবে একটি অসহায় মেয়েকে ‘ভিকটিম’ বানানো যাবে; কিন্তু আইনের শাসনের জন্য বিষয়টি শুভ হবে না।

 লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047760009765625