দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভীষণ অসুখ! স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে ২০২১ সালে। এ বছর পেরোলে দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছর উদযাপন করবে। শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, চারটি সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, একটি প্রকৌশল ও একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার ১৪ বছর পর জেনারেল এরশাদ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন জাতিকে জানান। আর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সব জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সবার জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়- সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অনিয়ম, নিপীড়নসহ বহুমুখী অসুখে অসুস্থ। সবার আশা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন সুস্থ শিক্ষার পরিবেশ ফিরে পায়। সবাই উদ্বিগ্ন, কবে সুস্থতা ফিরে পাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? কবে কোন সকালে পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে চমকে উঠব, আনন্দিত হয়ে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে বলব. দেখো দেখো ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে এবার ২ ও ৩-এ এসেছে! কিংবা দেখব সাংবাদিকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বাসার সামনে অপেক্ষা করছেন কখন নোবেল বিজয়ী সাক্ষাৎকার দেবেন।
আজ সকালে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি একজন হেডমাস্টারের সন্তান। কথা বলতে গিয়ে বললেন, দুই সন্তান ও তাদের স্ত্রীদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন পিএইচডি করতে। জানালেন, তার সন্তান প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও চাকরি পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন জাপানে আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন দেশে ফিরতে। কিন্তু বাবা বলছেন না ফিরতে! কারণ, দেশে ফিরলেও ন্যায়বিচার পাবেন না! কী সাংঘাতিক কথা! আমাকে তো ছোট-বড় সবার কাছ থেকে সকাল-বিকাল শুনতে হয়- কেন চলে যান না? কেন এসেছেন এ দেশে? এখানে ন্যায়বিচার পাবেন না! আমি তাদের প্রকৃতির বিচার ও শাস্তির কথা বলি।
একবার শুনেছিলাম, হতভাগাদের দেশ নেই। এখন দেখি আমি সেই হতভাগা! একদিন শিশু হয়েও লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর টহল ট্রাকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করিনি। কিন্তু আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরারকে নির্মমভাবে মরতে হয় দেশ নিয়ে তার ভাবনা প্রকাশের জন্য! যে দেশ পেয়েছি আজ, তা আমার নয় বলে মনে হয়! বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা কিংবা জাতির জনক বা তাদের সহযোদ্ধারা এই বাংলাদেশ চাননি!
এ কোন বাংলাদেশ, যে দেশের স্বার্থের কথা বললে নির্মমভাবে মরতে হয়? এ কোন দেশ, দুর্নীতির কথা বললে ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীর হাতে মার খেতে হয়? এ কোন দেশ, যেখানে পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে ক্ষমতায় যেতে চাওয়া হয়?
এ দেশ আমার দেশ। এ দেশ ৩০ লাখ শহীদের দেশ, এ দেশ মুজিবের বাংলাদেশ। এ দেশ ছেড়ে আমি কোথায় যাব? আমার শুভাকাক্সক্ষীদের উদাহরণ দিয়ে বলি- ন্যায়বিচার আল্লাহ করবেন, যখন তিনি মনে করেন। কোনো ব্যতিক্রম হবে না। আজ যারা ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়ে শিক্ষকদের পেটাতে বলে, শিবির নয় তবু শিবির বলে প্রচার করে হত্যা করে, একদিন ওই হত্যাকারীরা আদেশদাতাদের হত্যা করবে। কারণ নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলে- ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’।
বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের আলো দিয়ে সমাজ, মন ও দেহের রোগ সারায়। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয় যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তাকে সারাবে কে? হ্যাঁ, সেই মহান কাজটি আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ই সারাবে। আর তাই আজ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক-ছাত্র আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুখ সারানোর জন্য। সে আন্দোলনে পাশে আছে গণমাধ্যম। আর সবার উপরে আছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি বলেছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা। হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হবে শুদ্ধধারা কোনটি তা চিহ্নিত করে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। সেই পরম জ্ঞান কেবল সত্য নয়, সেটি আসলে সুন্দর ও শুভ।
আসছে ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করে হত্যা করা হয়েছিল দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ অনেককে। এরপর ৯ মাস যুদ্ধ চলে। ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও অনেক অধ্যাপককে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকসেনারা। বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর।
সেই স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে রমনা রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
এই মহান নেতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই- এবারের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুখ সারানোর আন্দোলন, এবারের সংগ্রাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের সংগ্রাম। দেশ তাকিয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে- অসুস্থ বিশ্ববিদ্যালয়কে সুস্থ করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার আন্দোলনে সংবাদমাধ্যমে কর্মরত বুদ্ধিজীবীদের মতো মুক্তিকামী জনতাও যোগ দিয়ে দেশের সুস্থতা ও শান্তি ফিরিয়ে আনবে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে।
ড. ফরিদ আহমেদ : অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।