আঁধারের পাড়ায় আলোর রেখা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে সোয়া তিন কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের পশ্চিমের এক এলাকার নাম পশ্চিম দেওয়াননগর সন্দ্বীপপাড়া। এলাকাটি হাটহাজারী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। দীর্ঘদিন ধরে অনেক পরিবারের বসবাস এই এলাকায়। বর্তমানে পরিবারের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি। এই বিপুলসংখ্যক পরিবারের কর্তাদের পেশায় কেউ দিনমজুর, কেউ রিকশাচালক, কেউবা সিএনজিচালক, কেউ আবার বর্গাচাষি, কেউ পরের বাসায় কাজ করেন, কেউ গার্মেন্টকর্মী আবার কেউ কেউ করেন বাবুর্চির কাজ। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবার এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। শিশুদের পড়াশোনার জন্য এই এলাকায় নেই কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নেই খেলার মাঠ কিংবা বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা। এই এলাকার নিকটবর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি, যার দূরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার। অর্থ ব্যয় করে ভর্তি করিয়ে, মাসে মাসে বেতন দিয়ে কিংবা আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছা, সামর্থ্য কিংবা আগ্রহ এলাকার অধিকাংশ পরিবারের নেই। তাই পড়ালেখার পরিবর্তে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের উপার্জনের নানা কাজে সম্পৃক্ত করতেই যেন তারা বেশি আগ্রহী। শনিবার (১৬ নভেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

দুই. এই এলাকার শিশুদের শিক্ষার জন্য ১৯৯৭ সালে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। স্কুলটি ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভালোই চলছিল। এর পরই ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ওই বেসরকারি সংস্থাটি হঠাৎই তাদের প্রকল্প শেষ করে স্কুলটি আর চালাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরই মধ্যে বন্ধ করে দেয় তাদের অর্থায়ন, গুটিয়ে নেয় সব কার্যক্রম। এরপর থেকে অর্থাভাবে বিদ্যালয়টি ক্রমাগত জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হতে থাকে। ক্রমে হয়ে পড়ে প্রায় পাঠদান অনুপযোগী। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। অর্থ সংকটের কারণে শিক্ষকদের বেতন না থাকায় ছিলেন না নিয়মিত শিক্ষক। শিক্ষানুরাগী কিছু তরুণ-তরুণী এবং একজন প্রবীণ শিক্ষক বিনা বেতনে কোনো রকমে চালিয়ে নিচ্ছিলেন স্কুলটি। চলতি বছরের প্রথম দিকে বিদ্যালয়টি হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের নজরে আসে। খবর পাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই পরিদর্শনে গিয়ে বিদ্যালয়ের নাজুক অবস্থা অবলোকন করে বিস্মিত হয় প্রশাসন। যে সময় প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে চলেছেন, ঠিক সে সময় এ রকম জরাজীর্ণ একটি প্রাইমারি স্কুল থাকাটা কল্পনাতীত। তৎক্ষণাৎ পরিকল্পনা নেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয় উন্নয়ন করে শিশুদের স্কুলমুখী করার। প্রথমেই শুরু হয় জরাজীর্ণ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ।

স্থানীয় জনসাধারণ, সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসকসহ সবাইকে সম্পৃক্ত করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উদ্যোগে জরাজীর্ণ ও প্রায় ভঙ্গুর বিদ্যালয়টি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হয়। দরজা, জানালা, দেয়াল, ছাদ, সিলিং সব বদলে নতুন রূপ দেওয়া হয়। তিনটি শ্রেণিকক্ষ একেবারে প্রস্তুত করা হয় নতুন করে। শ্রেণিকক্ষগুলোতে দেওয়া হয় নতুন বেঞ্চ, বৈদ্যুতিক পাখা, নতুন ব্ল্যাকবোর্ডসহ নানা শিক্ষা উপকরণ। শিক্ষকদের জন্য তৈরি করা হয় পৃথক টিচার্স রুম। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের ব্যবহার অনুপযোগী আসবাবপত্র বদলে দেওয়া হয় নতুন আসবাবপত্র। এমনকি দিনের অ্যাসেমব্লির জন্য নতুন ফ্লাগস্ট্যান্ড ও জাতীয় পতাকাও যোগ করা হয়। ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলতে থাকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল না কোনো শৌচাগার। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনের সময় নিজের বাড়ি অথবা প্রতিবেশীদের বাড়িতে চলে যেত। মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে বিদ্যালয়মুখী হতে চাইত না কেবল শৌচাগার না থাকার কারণে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দিতে তৈরি করা হয় মানসম্মত শৌচাগার। বিদ্যালয়ের পাঠদান পরিবেশ নির্বিঘ্ন করতে নির্মাণ করা হয় সীমানা দেয়াল। নির্মাণ করা হয় দৃষ্টিনন্দন গেট। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হতো আশপাশে অবস্থিত বাড়ির টিউবওয়েলের ওপর। এখন এ সমস্যা দূর করতে বিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যেই স্থাপন করা হয় গভীর নলকূপ। শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না বিদ্যালয়টির। এখন সাময়িক সময়ের জন্য শিক্ষকদের প্রতিমাসে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে প্রতীকী সম্মানী।

তিন. নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, আসবাবপত্র সরবরাহ, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, স্যানিটেশন সমস্যা দূরীকরণের পর শিক্ষার্থীদের স্কুলের প্রতি আগ্রহী করতে উদ্যোগী হয় উপজেলা প্রশাসন। নেওয়া হয় নানামুখী উদ্যোগ। আড়াই হাজার পরিবারের এই জনপদের শিশুদের জন্য কোনো খেলার মাঠ না থাকায় তারা বঞ্চিত ছিল খেলাধুলা ও বিনোদন থেকে। অথচ খেলাধুলার প্রতিই শিশুদের প্রবল আগ্রহ থাকে। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে স্কুলের সামনের জঙ্গল, খানাখন্দ এবং পরিত্যক্ত স্থাপনা ভেঙে বিশাল প্রশস্ত একটি খেলার মাঠ তৈরি করা হয়। ফুটবল ও ক্রিকেটসহ নানা ক্রীড়াসামগ্রী উপহার দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। মেয়েদের জন্যও ক্রীড়াসামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়। খেলাধুলা নির্বিঘ্ন করতে সীমানা দেয়াল নির্মাণ করে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যবস্থা করা হয় স্কুলে বিনামূল্যে ভর্তির। উদ্যোগ নেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের। বাচ্চাদের আকৃষ্ট করতে শিশুপার্কের মতো কিছু রাইডও দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশার কথা, মাত্র দুই-তিন মাসের মধ্যেই এসব উদ্যোগের অভাবনীয় ফল পাওয়া যায়। তিন মাসের ব্যবধানে নতুন ভর্তি হয় ৭৬ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় দ্বিগুণেরও বেশি। যে শ্রেণিকক্ষে মাত্র কয়েক মাস আগেও ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পাঠদান চলেছিল, সেই শ্রেণিকক্ষে এখন স্থান সংকুলান হচ্ছে না। যে ক্লাসরুমে কয়েক মাস আগেই কয়েক জোড়া বেঞ্চ নিয়ে পাঠদান কার্যক্রম চলত, সেখানে ১৫ জোড়া বেঞ্চ দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের কষ্ট করে বসতে হচ্ছে। প্রতিদিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই বিদ্যালয়ে চলে আসছে শিক্ষার্থীরা। এখন বাচ্চারা কেউ স্কুল ফেলে কাজে যেতে চায় না। বরং এখন শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু সন্দ্বীপপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। আগামী নতুন বছরের প্রথম মাসেই এই শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে প্রত্যাশারও বাইরে।

আঁধারের পাড়ায় জ্বলে উঠুক শিক্ষার আলো। আলোর রেখা বিচ্ছুরিত হোক সর্বত্র। শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হোক আগামী প্রজন্ম।

লেখক: মোহাম্মাদ রুহুল আমীন, সরকারি কর্মকর্তা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0054948329925537