আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরিচালক জাহাঙ্গীরের করা কটূক্তির ময়নাতদন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক |

একাত্তরে ক্রাক প্লাটুনের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এস এম শহীদুল্লাহ খান বাদল। যিনি বঙ্গবন্ধুর কৃপায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হতে পেরেছেন। বাদল খানের স্ত্রী একাত্তরের মুক্তির গানের সেই বিখ্যাত নায়লা জামান। নায়লা জামান সেক্টর কমান্ডার লে. কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান বীর উত্তমের কন্যা। শহীদুল্লাহ খান বাদলের সহোদর বাম রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ রাশেদ খান মেনন। বিএনপি নেত্রী বেগম সেলিমা রহমান তাদের সহোদরা। তাদের পিতা পাকিস্তান জমানার স্পিকার জব্বার খান। আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়ার ‘অপরাধে’ তুখোড় ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননকে ত্যাজ্যপূত্র ঘোষণা করেছিলেন তাঁর পিতা। পাকিস্তানি জান্তাদের খুশী করতেই জব্বার সাহেব ওই কাজটি করেছিলেন বলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে শুনেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিদের দোস্ত জব্বার খানের বাসায় বোমা মারার জন্য ক্রাক প্লাটুন সদস্যদের মধ্যে যখন দায়িত্ব বন্টন করা হয় তখন সিনিয়র যোদ্ধারা জানতে পারেন গেরিলাযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদলের পিতাই স্পিকার জব্বার খান। 

পাঠক, এবার দুটি ছোট্ট প্রসঙ্গের অবতারণা করেই তদন্ত কমিটির ‘ধান ভানতে শিবের গীতের’ ময়নাতদন্ত করবো।  

“জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না”। নিজের মালিকানাধীন বাংলাভিশন টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে সাঈদীর পক্ষে এমনই সাফাই গেয়েছিলেন ক্রাক প্লাটুনের আরেক সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সদ্য প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা। কয়েকবছর আগে যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাঈদীকে গ্রেফতারের পরপরই এমন কথাই বেরিয়ে আসে ভাসানী ন্যাপ থেকে বিএনপিতে যোগ দেয়া খোকার মুখ থেকে। অথচ ট্রাইবুনালের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে ‘দেইল্লা রাজাকার’ ওরফে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ওরফে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। দণ্ডিত সাঈদী এখন জেলে।   

এবার বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের একজন মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার স্বাধীনতাবিরোধী মতপ্রকাশ ও জাতিরপিতাকে নিয়ে কটূক্তি করার গল্প উপস্থাপন করছি। শওকত আলী নামের এই আদর্শচ্যুত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শিক্ষক বিএনপি-জামাত জমানায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছিলেন। খুব সম্ভবত ওই পদে থেকেই তিনি অবসরে যান। ওই পদে আসার আগে তিনি নরসিংদী সরকারি কলেজে ছিলেন। সেখানে শওকতের তৎকালীন একজন সহকর্মী যিনি বর্তমানে শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত তিনি গত সপ্তাহে দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ‘শুধু জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কটূক্তি আর স্বাধীনতাবিরোধী কথা বলার পুরস্কার হিসেবে শওকতকে শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক পদে বসানো হয়েছিল।’ 

পাঠক, ধৈর্য্যচ্যুত হবে না। এটাই শেষ গল্প। গল্প নয়, এটাও সত্যি ঘটনা। শিক্ষা ভবনেরই। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের শ্যালিকা ও শিক্ষা ক্যাডার সমিতির নেতা অধ্যাপক নাছরিন বেগম তার পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করার জন্য অনুমতি চেয়ে একটি আবেদন করেন অধিদপ্তরে। দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এবং বিসিএস সমিতির সভাপতি নাছরিন মহাপরিচালক হবেন এই গন্ধ পেয়ে শিক্ষা ভবনের অনেকেই নাছরিনের সাথে তলে তলে যোগাযোগ রাখতেন। অধিদপ্তরে নাছরিনের যে কোনও কাজ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সম্পন্ন হতো। এমনই ধান্দায় লিপ্ত শিক্ষা ক্যাডারের কুখ্যাত বাড়ৈ সিন্ডিকেটের সদস্য ও এইচআরএম শাখার একজন নারী সহকারি পরিচালক পদে ছিলেন রেহানা। অধ্যাপক নাছরিনের পাসপোর্ট সংক্রান্ত আবেদনের ফাইলটি নিয়ে রেহেনা ছুটে যান পরিচালক অধ্যাপক কাসেম মিয়ার কাছে। নিয়ম ভেঙ্গে দ্রুত সই করার তাগাদা দেন পরিচালককে। রেহেনার হাতে নাছরিনের ফাইল দেখে বিরক্ত হন অধ্যাপক কাসেম।  কষে ধমক দেন রেহেনাকে। কাসেম মিয়া জানতে চান নাছরিনের আবেদন নিয়ে তার নাক গলানো কেন? তস্য জুনিয়র রেহেনাকে সামান্য ধমক দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অধ্যাপক কাসেমের বিরুদ্ধে জামাতপন্থী সাংবাদিকদের দিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করাতে থাকে। অভিযোগ করা হয় কাসেম মিয়া রেহেনার দিকে তরিকুলের শ্যালিকা নাছরিনের আবেদনটি ছুড়ে মেরেছেন। জামাতের  মুখপত্র হিসেবে পরিচিত পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা কাসেম মিয়াকে ওএসডি করা হয়। অধ্যাপক কাসেমের স্ত্রী তখন ক্যান্সার আক্রান্ত। কাসেম মিয়াকে বদলি করা হয় কুমিল্লার সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে। শিক্ষা অধিদপ্তরের তৎকালীন উপ-পরিচালক পদে সম্প্রতি ১৫ ও ২১ আগস্ট নিয়ে কটূক্তি করায় অভিযুক্ত শিক্ষা ক্যাডারের ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর অধিষ্ঠিত ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাসেম মিয়াকে ওএসডি ও কুমিল্লায় বদলি হতে হয়েছিল বিএনপিনেতা তরিকুলের শ্যালিকার পাসপোর্ট সংক্রান্ত আবেদন অনুমোদনে বিদ্যুৎ গতি না থাকায়! অধ্যাপক কাসেমের পদে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আরেকজনকে পদায়ন করা হয়। বিএনপি নেতা তরিকুলের শালিকার ফাইল অগ্রায়নে রেহেনার অযাচিত তদবিরের শাস্তি হয়নি আজও। সেই রেহানাকেই চলতি বছরের জুলাই মাসে ঘুষখোরদের সোনার খনি হিসেবে পরিচিত এক দপ্তরের উপপরিচালক করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কাসেম মিয়ার পক্ষে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দ। অধ্যাপক কাসেমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এসএম গোলাম ফারুক।  প্রশাসন ক্যাডারের গোলাম ফারুক পরে বিমান ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হন। অবসরে যেতে না যেতেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হন চলতি বছর।     

বিএনপি-জামাত জমানায় ১০ শতাংশ কোটায় উপসচিব হওয়া এই সফিউদ্দিনই ১৫ আগস্ট নিয়ে করা কটূক্তির ঘটনার তদন্ত কমিটির প্রধান!  

প্রিয় পাঠক, গত ২৩ আগস্টের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ১৫ ও ২১ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডকে ‘নিছক দুর্ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে ওএসডি করা হযেছে। শিক্ষা ক্যাডারে অসন্তোষ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তাকে ওএসডি করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো: গোলাম ফারুক।

মহাপরিচালক ২২ আগস্ট রাতে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ওই কর্মকর্তার বক্তব্যসহ সার্বিক বিষয় মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাকে প্রথমে ওএসডি করে পরে তদন্ত করা হবে।’

জনকন্ঠের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এর আগে ২১ আগস্ট সিরডাপ মিলনায়তনে একটি সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে কথা বলার সময় অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের ঘটনাকে দুটি দুর্ঘটনা বলে মন্তব্য করে বলেন, ‘আগস্ট মাসে দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। আমি দুর্ঘটনা বা ঘটনায় শাহাদাতবরণকারী সকলের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আলোচনা শুরু করছি।’ গোলটেবিলের সঞ্চালক ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা রোকেয়া কবীর ড. জাহাঙ্গীরের মন্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘আগস্ট হত্যাকাণ্ড কোনও দুর্ঘটনা না। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’

১৭ নভেম্বর রোকেয়া কবির বলেছেন, ‘নারীদের সম্পর্কে মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার অধিকারী জাহাঙ্গীর কীভাবে জেনারেশন ব্রেক থ্রু প্রকল্পের পরিচালক হন?   

জাহাঙ্গীর সম্পর্কে আরো বলেন, ‘ ২১ আগস্টে সিরডাপেরর সেমিনারে (জাহাঙ্গীর) কোন দু:খ প্রকাশ করেননি বা কোন সংশোধন করেননি। এমনকি তার বড়ি ল্যাংগুয়েজও এমন ছিল যে তিনি ভুল করেছেন বা দূ:খিত হয়েছেন এমনটা মনে হয়নি। বরং তিনি বিরক্তির সুরে বলেন, “যে ঘটনা (১৫ ও ২১ আগস্ট) ঘটেছে সে ঘটনার শহীদদের কথা স্মরণ করতে চেয়েছি।” 

অথচ আদালতে প্রমাণিত, পরিকল্পিতভাবে ১৫ আগস্ট সপরিবার জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামাী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করতে গ্রেনেড হামলা করা হয়।  অলৌকিকভাবে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ শহীদ হন ২৪ জন। আহত হন তিনশতাধিক।  

প্রিয় পাঠক, জাহাঙ্গীরকে ওএসডি করা হয় আগস্টে আর তদন্ত কমিটি করতে মন্ত্রণালয় আড়াই মাস সময় নেয়! গত সপ্তাহ কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে মন্ত্রণালয়ে। এবার ওই তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর দৈনিক শিক্ষার ময়না তদন্তের ছুরি-কাঁচি রাখলাম। শুরুতেই বোঝা গেল বিএনপি-জামাত জমানার বিশেষ সুবিধাভোগী একজন কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান সফিউদ্দিন একজন পোস্টাল ক্যাডার কর্মকর্তা। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপি-জামাত জমানায় ১০ শতাংশ কোটায় বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতি পান। ফেনীতে জন্ম নেয়া সফিউদ্দিনের স্কুল-কলেজ ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লায়।  

শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক কাসেমের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (প্রশাসন) এস এম গোলাম ফারুককে তদন্তের ভার দেয়া হয়েছিল। গোলাম ফারুক বিমান ও স্থানীয় সরকার সচিব এবং সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে চলতি বছর অবসরে যান। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য। কিন্তু জাহাঙ্গীরের তদন্তে কেন মাদরাসা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (মো: সফিউদ্দিন) যিনি বিএনপি-জামাত জমানার বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত উপসচিব?  জাহাঙ্গীরের সাবেক পদটি (পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এখনও খালি কেন? 

সফিউদ্দিনের কমিটির প্রতিবেদনে কেন ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হল? জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ওঠা কটূক্তির অভিযোগ  নিয়ে প্রতিবেদন লেখা কোনও সাংবাদিকের সাথেও কেন কথা বলেনি, তথ্য সংগ্রহ করেনি? ৩২তম বিশেষ বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান যারা শিক্ষা অধিদপ্তরে পদায়ন পেয়ে পাঁচ বছর ধরে জাহাঙ্গীর কর্তৃক নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের বক্তব্য কেন নেয়া হয়নি? জাহাঙ্গীরকে ওএসডি করার খবরে যারা মিষ্টি বিতরণ করেছেন সেইসব শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেয়া হয়নি? 

জাহাঙ্গীর যেদিন ওই বক্তৃতা দেন সেদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান, দীর্ঘদিন এনসিটিবিতে থেকে সদ্য ওএসডি অধ্যাপক ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকী ওরফে রতন সিদ্দিকী। এনসিটিবির আরো কয়েকজন কর্মকর্তা। কিন্তু সফিউদ্দিনের তদন্ত কমিটি তাদের কারো কাছে কিছুই জানতে চায়নি।

২১ আগস্ট সিরডাপে অনুষ্ঠিত ও সেমিনারে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই ১৫ ও ২১ আগস্টের শহীদদের স্মরণ করেন। আর জাহাঙ্গীর রোকেয়া কবিরের বক্তব্যেরই এক ধরণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৫ ও ২১ আগস্ট সম্পর্কে কটূক্তি করেন। বধূদের সাথে শাশুড়ীর সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়েও একই অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরের করা মন্তব্য নারী নেতৃদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। জাহাঙ্গীর র্সেদিন বলেছেন, শ্বাশুড়ী সামনে কাঁপতে কাঁপতে বধুর হাতে থাকা পানির গ্লাসটি থেকে পানি পড়ে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।’ এই বক্তব্যেরও প্রতিবাদ করেছেন রোকেয়া কবির। সেই রোকেয়া কবিরের বক্তব্য নেয়নি তদন্ত কমিটি।  কিন্তু কমিটি ঠিকই জাহাঙ্গীরকে রক্ষায় ‘ধান ভানতে শিবের গীত গেয়েছে।’ 

তদন্ত কমিটি বিষয়ব্যক্তি ড. জাহাঙ্গীরের চাইতে তাঁর পিতৃ পরিচয় ও পিতার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ওপর তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ ও সেগুলোর বরাত দেয়ার পেছনে যত সময় ব্যয় কারেছেন বেশি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা কারণে, নানাভাবে মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। জাহাঙ্গীরের পিতাও নিখোঁজ। অভিযোগ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কিন্তু তদন্ত কমিটি কাগজ ও সংযুক্তি বেশি নিয়েছে জাহাঙ্গীরের পিতার ওপর । এসব দেখে শুধু অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরই না কমনসেন্সওয়ালা যে কোনও মানুষেরই মনে হবে কমিটি ‘ধান ভানতে শিবের গীত গাইল।’  

পাঠক, রাজাকারের পক্ষেও যে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফাই গাইতে পারে, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার পিতাও যে স্বাধীনতাবিরোধীতদের পক্ষে থাকতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাও যে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কটূক্তি করতে পারেন সেই উদাহরণ শুরুতেই দিয়েছি। 

জাহাঙ্গীরের পিতৃ পরিচয় তুলে ধরতে শশব্যস্ত কয়েকজনের ঠিকানা-ঠিকুজির খোঁজ নেয় দৈনিক শিক্ষা। শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষার ময়নাতদন্তে দেখা যায়, তারা সবাই মীর জাফর, কাজী জাফর, খন্দকার মোশতাক, তাহের ঠাকুর ও মাহবুবুল আলম চাষীদের নিকটতম প্রতিবেশী। তদন্ত কমিটির প্রধান সফিউদ্দিনেরও বাড়ী ফেনী হলেও ডিস্ট্রিক্ট কুমিল্লা!  অভিযুক্ত ড. জাহাঙ্গীরের নিজ জেলাও কুমিল্লা বলেই জানা গেছে।     

পাঠক, দৈনিক শিক্ষার আরেকটি ময়নাতদন্ত। এটাই শেষ।

অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর যখন শিক্ষা অধিদপ্তরে উপপরিচালক পদে ছিলেন তখন তার বিরুদ্ধে ভিন্ন কারণে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কেন আজ অধিদপ্তরের ফাইলে নেই? কেন একটি ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করে বর্তমান প্রশাসনের কাছে তুলে ধরে নিজেকে সুফি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে জাহাঙ্গীরকে? এসব নিয়েও ময়নাতদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। প্রায় ছয় বছর আগে গঠিত ওই কমিটির প্রধান ছিলেন অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক দীপক কুমার নাগ। সদস্য ছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনা শাখার উপপরিচালক মো: বশির উল্লাহ। অ্যাপক নাগ এখন অবসরে আর বশিরউল্লাহ কাগজেপত্রে ভোলা সরকারি কলেজে। ওই কমিটির প্রকৃত প্রতিবেদন উদ্ধার ও সুপারিশ বাস্তবায়ন দাবি করছি।   

প্রিয় পাঠক, শিরোনামে কেন ময়নাতদন্ত শব্দ ব্যবহার করলাম, তার একটি কৈফিয়ত দিচ্ছি। যতদূর জানা যায়, সতেরশো শতক থেকে অস্বাভাবিক মৃত্যুর পোস্টমর্টেমের রীতি চালু রয়েছে। মেডিকেল ও ক্লিনিক্যাল ছাড়া  একাডেমিক কাজেও ময়নাতদন্ত দরকার।

আমরা জানি, অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুর পরেও কারো মৃত্যু নিয়ে যদি বিতর্ক তৈরি হয়, তখন ক্লিনিক্যাল পোস্টমর্টেম করা হয়। জানা যায়, ময়না শব্দটি ফার্সি বা উর্দু থেকে এসেছে, যার অর্থ ভালো করে খোঁজা বা অনুসন্ধান করা। ফলে ময়না তদন্ত মানে হলো ভালো করে তদন্ত করে দেখা। যেহেতু মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকরা এই কাজটি করে থাকেন, এ কারণেই এর নাম হয়েছে ময়না তদন্ত।

প্রিয় পাঠক, ময়না তদন্ত কি শুধু চিকিৎসকদের জিম্মায়ই থাকবে? আসুন এর ব্যবহার শিক্ষাখাতেও শুরু করি। শিক্ষার নির্বাহী প্রধান হিসেবে আমরা পেয়েছি ডা: দীপু মনিকে আবার ওয়াচডগ হিসেবে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদেও পেয়েছি আরেকজন ডাক্তারকে। তিনি ডা: মো: আফছারুল আমীন। 

আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাহাঙ্গীরের করা কটূক্তি ও ধান ভানতে শিবের গীতমার্কা তদন্ত প্রতিবেদন শুধু প্রত্যাখানই করছি না, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. অরুণা বিশ্বাস অথবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত অতিরিক্ত সচিব বেলায়েত হোসেন তালুকদারকে দিয়ে ফের তদন্ত করানোর দাবি করছি। একইসাথে শিক্ষা প্রশাসনে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিতকরণ ও দুনীতির মুলোৎপাটনে একাধিক ময়নাতদন্ত কমিটি গঠনের দাবি করছি। যা এখনই শুরু হওয়া সময়ের দাবি 

আরও পড়ুন: খালেদার সাথে গোপন বৈঠক : সেই শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারাও শিক্ষা ভবনে


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত - dainik shiksha ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল - dainik shiksha শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে - dainik shiksha ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল - dainik shiksha ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0080628395080566