আন্ডার ওয়ার্ল্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য সম্রাটের মুখে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আন্ডার ওয়ার্ল্ড। এক বিস্ময়কর নাম। আধিপত্য নিয়ে যেখানে প্রায়ই ঘটে অস্ত্র ও রক্তের খেলা। সবসময়ই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ড। এমনকি বিদেশে বসেও আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করে সন্ত্রাসীরা। আধিপত্য বিস্তার, অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে প্রায়ই খুন-খারাবির ঘটনা ঘটে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকেই আন্ডার ওয়ার্ল্ডে নজর পড়ে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের। যুবলীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মী থেকে মহানগরের নেতা হওয়া সম্রাটের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের। শনিবার (১৯ অক্টোবর) মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রুদ্র মিজান।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিজেও গড়ে তোলেন সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হওয়ার পর পুরো ঢাকার অপরাধ জগতে আধিপত্য বিস্তার করেন সম্রাট। তার আধিপত্য মেনে নিতে যারাই অস্বীকার করেছেন তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে, সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সহজেই আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রনে নেন তিনি। রিমান্ডে থাকা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে এসব নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে আন্ডারওয়ার্ল্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন সম্রাট।

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব। র‌্যাবের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি টিম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সূত্রে জানা গেছে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন সম্রাট। মাঝে মাঝে ভুলে যাওয়ার ভান করছেন। তার উপার্জিত অর্থ, অস্ত্র ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তার দেয়া তথ্য নোট করা হচ্ছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ড, অস্ত্র, মাদক, অবৈধ অর্থ, জবর-দখলসহ সকল অপকর্ম নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সম্রাট ও আরমানের দেয়া তথ্য যাচাই বাছাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

সূত্রমতে, একসময় ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রন করতেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে মালিবাগের একটি হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যা করে জিসান বাহিনী। তারপর দেশের বাইরে আত্মগোপনে যান জিসান। ক্লিন হার্ট অপারেশনসহ বিভিন্ন কারণে ওই সময় থেকেই একে-একে দেশ ছাড়েন ঢাকার অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৯শে জুলাই রাতে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে হত্যা করা হয়। গুলশানের ১২৩ নম্বর সড়কের বিপনী বিতান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে তাকে  হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। যুবলীগের একটি পক্ষ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের পর থমথমে ছিল আন্ডাওয়ার্ল্ড। মিল্কি হত্যার পর আসামিরা ছিল আত্মগোপনে। এরমধ্যেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরো নিয়ন্ত্রন চলে যায় যুবলীগের দক্ষিণের সভাপতি সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে। শুরু থেকেই সম্রাটের পাশে ছিলেন অস্ত্রের রাজনীতিতে প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূইঁয়া। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত খালেদ মাহমুদ ভূইঁয়ার নাম শুনলেই কেঁপে উঠে খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, মতিঝিল এলাকার মানুষ।

দীর্ঘদিন থেকেই সম্রাট ও খালেদ মিলে পুরো ঢাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী এক ক্যাডার বাহিনী। প্রতিটি ওয়ার্ডে ছিল তাদের অনুসারীরা। তাদের চাঁদাবাজি, জবর-দখলে কেউ বাধা দিলেই জানানো হতো সম্রাটের দরবারে। কাকরাইলের ভূইঁয়া টাওয়ারে সম্রাটের অফিসেই সকল অপকর্মের পরিকল্পনা করা হতো। যারা বাধা হতো তাদের ডেকে আনা হতো সেখানেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জোর করে তোলে আনা হতো। তারপর ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা নির্যাতন করতো নির্বিঘ্নে। নির্যাতনের ক্ষেত্রে ইলেকট্রিকের শকও দেয়া হতো। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ থেকে শুরু করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে রিমান্ডে থাকা সম্রাটকে।

সরকারি বিভিন্ন কাজের টেন্ডার, ক্যাসিনো, অবৈধ মার্কেট ও চাঁদাবাজি থেকেই বেশি টাকা উপার্জন হতো সম্রাটের। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। আন্ডার ওয়ার্ল্ডে সম্রাটের হয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন খালেদ। ক্যাসিনো ব্যবসাও দেখাশোনা করতেন তিনি। খালেদের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় জিসানের সঙ্গে। জিসানকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা দিতেন সম্রাট। একাধিকবার সিঙ্গাপুরে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে সম্রাট, খালেদের বৈঠক হয়।

সম্রাটের দেয়া তথ্যানুসারে, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের ভাগ পেয়েছেন অনেকে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্তত ১১ জন সংসদ সদস্য সম্রাটের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়েছেন। ভোলার একজন এমপি নিয়মিত টাকার ভাগ নেন। নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে সম্রাটের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে এলাকায় গিয়েছিলেন তিনি। ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের নাম, ঠিকানা রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারের বেশ আগে থেকেই খালেদের সঙ্গে দুরত্ব সৃষ্টি হয় তার। টাকার ভাগাভাগি নিয়ে এই দুরত্বের সূত্রপাত। একইভাবে দুরত্ব সৃষ্টি হয় জিসানের সঙ্গে। এজন্য আতঙ্কে ছিলেন। ধারণা ছিল জিসানের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হতে পারে। এজন্য দুবাই থেকে সন্ত্রাসী  ও একে-২২ রাইফেলসহ বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র পাঠান জিসান। গত ২৬শে জুলাই খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের বায়তুল হুদা মসজিদ সংলগ্ন ফাইভ স্টার নিবাসের সামনে থেকে অস্ত্রসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ বিষয়ে ওই সময়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহিদুর রহমান রিপন বলেছিলেন, গ্রেফতারকৃতরা পেশাদার সন্ত্রাসী। তারা বিদেশে অবস্থান করা একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর হয়ে কাজ করে। এই ঘটনার পর থেকে সম্রাট নিজে সন্ত্রাসীদের বহর নিয়ে চলাফেরা করতেন। খালেদের সঙ্গে দুরত্ব সৃষ্টির পর থেকে বিশ্বস্ত হিসেবে যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমান ছিলেন তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। একইভাবে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের হিসাব রাখতেন যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের দপ্তর সম্পাদক এমদাদুল হক। একই বিষয়ে সম্রাট ও আরমানকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব। সম্রাটের এই ক্যাডার বাহিনী, অস্ত্র, অবৈধ অর্থ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে র‌্যাব। সম্রাট প্রায়ই অসুস্থতার অজুহাতে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছেন। সূত্রমতে, আলাদভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পর দু’জনকে মুখোমুখি করা হবে।

উল্লেখ্য, যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে ১৫ই অক্টোবর ১০ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। একইভাবে সম্রাটের সহযোগী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানকেও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। গত ১৮ই সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের প্রথম দিনই গ্রেফতার করা হয় সম্রাটের সহযোগী যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। গত ৬ই অক্টোবর কুমিল্লা থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ওই দিন দুপুরে তাকে নিয়ে র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে কাকরাইল অফিসে তল্লাশি অভিযান করে র‌্যাব। এসময় পাঁচ রাউন্ড গুলি ভর্তি একটি ম্যাগাজিনসহ বিদেশি পিস্তল, ক্রেংক্রারুর চামড়া, এক হাজার ১৬০ পিস ইয়াবাসহ বিপুল মাদক জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় রমনা থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। সেইসঙ্গে বন্যপ্রাণীর চামড়া রাখার দায়ে সম্রাটকে ছয় মাস ও গ্রেফতারের সময় মদ্যপ অবস্থায় থাকায় আরমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026350021362305