৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এক বিশেষ প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিনটির প্রতিপাদ্য 'সাক্ষরতা অর্জন করি, দক্ষ হয়ে জীবন গড়ি'। গত বছর এর প্রতিপাদ্য ছিল 'সাক্ষরতা অর্জন করি, ডিজিটাল বিশ্ব গড়ি'। এর আগের বছর 'অতীতকে জানব, আগামীকে গড়ব'। যে কোনো বিশেষ দিবসের প্রতিপাদ্য বা স্লোগান সে দিবসের মাহাত্ম্যকে কেবল মহিমান্বিত করে না--বরং তা পালনের মূল উদ্দেশ্য নতুন করে সবার সামনে উন্মোচন করে দেয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের দিনেও আজ পর্যন্ত দুনিয়ার সব মানুষ শিক্ষার আলো দেখতে পায়নি। পৃথিবীতে আজও লক্ষ লক্ষ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা নিজের নাম-পরিচয়টুকুও লিখতে পারে না। কেউ এক টুকরো কাগজে কিছু লিখে দিলে তা পড়তে পারে না। অনেক দেশে বহু মানুষ আছে, যারা জীবনেও শিক্ষার ধারে কাছে যাবার সুযোগ পায়নি। মূলত সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ অবারিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের যাত্রা।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের বিগত ও চলতি বছরের স্লোগান বিশ্লেষণ করলে আমরা সে সত্যটুকুই খুঁজে পেয়ে থাকি। মুল আলোচনায় যাবার আগে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। সেটি হচ্ছে, কোনো তাৎপর্যপূর্ণ দিবসের আগে-পিছে কয়েকদিন দিবসটি নিয়ে সবার আগ্রহ ও উৎসাহ যেটুকু থাকে, কয়েকদিন যেতে না যেতে সেটুকু বিলীন হয়ে যায়। ঢাকঢোল পিটিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। সভা, সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দেন। জাতির মনে আশার সঞ্চার করেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করে। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতে আমরা দিনটি ভুলে যেতে থাকি। বছর ঘুরে আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত তা এক রকম বিস্মৃত থেকে যায়। এর প্রতিপাদ্য কিংবা স্লোগানকে সামনে রেখে আমরা কতটুকু অগ্রসর হই, সে প্রশ্নটি যে কেউ করতেই পারে। আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সে এক নিরেট সত্য কথা। প্রকৃত অর্থে এটি এক রকম প্রবঞ্চনা ও প্রহসনের নামান্তর। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের যাত্রা ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সে বছর ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইরানের রাজধানী তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের মর্যাদা প্রদান করে। সেই থেকে প্রতি বছর দিনটি সারা পৃথিবীতে পালিত হয়ে আসছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে দিবসটি যথানিয়মে পালিত হয়ে আসছে ।
সাক্ষরতা কী? ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো সাক্ষরতার যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়, সেটি পরবর্তী প্রতি দশকে পরিবর্তিত হতে থাকে। সাক্ষরতা হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এক মানবীয় অধিকার। প্রায় সকল দেশই বহু আগে থেকে নিজের মতো করে এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে রাখে। এক সময় কেউ বর্ণমালা পড়তে বা নিজের নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলে মনে করা হতো। বর্তমানে এ ধারণা অনেকটা প্রসারিত হয়েছে। এখন সাক্ষরতার জন্যে তিনটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। ১. ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে ২. নিজের ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে । ৩. দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক হিসেব-নিকেশ করতে পারবে।
সাক্ষরতার বিষয়টিকে এতো গুরুত্ব কিংবা প্রাধান্য দেবার মানে কী? আসলে সাক্ষরতার বহুমাত্রিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষে মানুষে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলেই এর গুরুত্ব আজ এতো বেশি। কেবল সাক্ষরতার মাধ্যমে আর্থিক মুক্তিই নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক মুক্তি আনয়নের মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে সাক্ষরতা এক বিশেষ হাতিয়ার। সাক্ষরতা মানুষের জীবনে শান্তি আনয়ন করে। ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়তা করে। গোটা সৃষ্টি জগৎ সম্পর্কে একমাত্র সাক্ষর ব্যক্তিই কিছু না কিছু জেনে থাকে এবং অন্যকে এ সম্পর্কে জানাতে পারে। কেবল লেখাপড়া জানা মানুষই জানতে পারে দুনিয়ার কোথায় কখন কী ঘটে চলেছে। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসনে সাক্ষরতা কার্যকর ভুমিকা পালন করে থাকে। পৃথিবীতে যেখানে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত লেগে আছে, সেখানে সাক্ষরতা অনেক পিছিয়ে বলেই সংঘাত দীর্ঘদিন জিইয়ে আছে। আফ্রিকা মহাদেশের সংঘাতময় দেশগুলোর বাস্তব চিত্র আমাদের সে কথাই বলে দেয়।
দারিদ্র্য কমিয়ে আনা, শিশুমৃত্যু রোধ করা, সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধি বিকশিতকরণের ক্ষেত্রে সাক্ষরতার জুড়ি নেই। একটি মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা মানুষকে সাক্ষরতা ও দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করতে সহায়তা করে থাকে। সাক্ষর মা-বাবা সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে উৎসাহিত হন, অব্যাহত শিক্ষায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে অনুপ্রাণিত হন। উন্নয়নের দিকে দেশকে ধাবিত করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ও সরকারকে চাপ প্রয়োগে সাহায্য করে থাকেন। নিরক্ষরতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও দুর্নীতি এক একটি ভয়ানক শত্রু। এই শত্রুদের বধ করতে শিক্ষা ও সাক্ষরতার মতো ধারালো অস্ত্র আর কিছু নেই । এ লক্ষ্যে সবার জন্য শিক্ষা এক অপরিহার্য অধিকার।
সাক্ষরতা বিশ্বব্যাপী এক অসাধারণ আন্দোলনের নাম। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে পৃথিবী জুড়ে এ আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ষোল আনা সাফল্যের মুখ দেখেনি। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ আজ অবধি সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৭৮ কোটিই লেখাপড়া জানে না। বয়স্ক প্রতি ৫ জনে ১ জন নিরক্ষর। এর দুই-তৃতীয়াংশ নারী ও শিশু। বিশ্বে ৬৪ শতাংশ নারী এবং ৭ কোটিরও বেশি শিশু লেখাপড়া তো দূরে থাক, অক্ষর পর্যন্ত চেনে না। বাংলাদেশেও চিত্রটি সন্তোষজনক নয়। বিশ্ব যেখানে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে, সেখানে অফুরন্ত সম্ভাবনার পরও আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে। এর প্রধান কারণ জনসংখ্যার বড় একটি অংশ এখনো নিরক্ষরতার বেড়াজালে আবদ্ধ।
সরকারি হিসেব মতে, বাংলাদেশে ৭ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষিতের হার ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ (পুরুষ ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ ও মহিলা ৫৩ দশমিক ৯ শতাংশ) এবং ১৫ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষিতের হার ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ (পুরুষ ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ ও মহিলা ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ)। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর খসড়া মতে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ এ বয়সী ৫১ শতাংশ মানুষ এখনও নিরক্ষর। তবুও দাবি করা হয় বাংলাদেশ ৭০ শতাংশের বেশি সাক্ষরতা অর্জন করেছে। শুধু অক্ষর চেনা থেকে যদি সে হিসেবটি নির্ণয় করা হয়ে থাকে, তবে কোনো কথা নেই। কিন্তু সাক্ষরতার প্রকৃত সংজ্ঞার নিরিখে হিসেবটি নিশ্চয় সে রকম নয়। অন্তত একজন লোক যদি পরিবারের বাজার খরচের তালিকার কাগজটি পড়তে না পারে, সাইনবোর্ড দেখে যদি বলতে না পারে তাতে কী লেখা আছে, নিজের মোবাইল নম্বরটা যদি সেভ করতে না পারে তাহলে তাকে কী করে সাক্ষর বলা যায়?
সাক্ষরতা আন্দোলনে বাংলাদেশের সম্পৃক্ত হওয়ার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের দেশে সাক্ষরতা আন্দোলনের সুত্রপাত। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ ও নওয়াব আব্দুল লতিফের চেষ্টায় অনেক নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ভি-এইড কার্যক্রমের আওতায় শত শত বয়স্ক দরিদ্র মানুষকে শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯৯১ সালে সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে সাক্ষরতা আন্দোলনকে আরও একধাপ এগিয়ে নেয়া হয়। সরকার সাক্ষরতা কর্মসূচি সফল করার জন্য প্রশংসনীয় অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ শিশুভর্তি ও ঝরে পড়া রোধে সকলের জন্যে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করে উপবৃত্তি প্রদান করছে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়ে থাকে। সবার জন্য না হলেও ডিগ্রিস্তর পর্যন্ত উপবৃত্তি চলমান আছে। হাওর-বাওর ও দুর্গম এলাকার শিশুদের শিক্ষার জন্য বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। স্কুল ফিডিং চালু করা হয়েছে। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসুচি চালু আছে। এসব কর্মসুচি সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। তবু স্বাধীনতা অর্জনের এতগুলো বছর পরও শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন থেকে আমরা বহুদূর পিছিয়ে। প্রকৃত সাক্ষরতা বলতে যা বোঝায়, সে মাত্রায় আমাদের সাক্ষরতা পৌঁছতে পারেনি।
দারিদ্র্যের কারণে এখনো অনেক শিশু স্কুলেই যেতে পারে না। জনসংখ্যার বড় একটি অংশ সাক্ষরতার বিষয়ে কুসংস্কারে ভুগে থাকে। সাক্ষরতার নানা কর্মসূচি দুর্নীতির কারণে মাঝপথে থেমে যায়। রাজনৈতিক স্থিতিহীনতা ও ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন কর্মসূচি মাঝপথে বন্ধ হয়ে পড়ে। কেবল বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর অনেক দেশে এটি ঘটে থাকে।
আমাদের প্রত্যাশার ডালপালা অনেক। এবারের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে আমাদের প্রত্যাশা হোক সবার জন্য অবারিত শিক্ষার সুযোগ। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে হোক। শিক্ষা হোক জীবনের জন্য। সাক্ষরতা বয়ে আনুক সবার জন্য অনুপম সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির সুবাতাস। সাক্ষরতাকে হাতিয়ার করে দুনিয়ার সব মানুষের জীবন হয়ে উঠুক অনাবিল প্রশান্তির ঠিকানা। শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌহার্দ্যের এ পৃথিবীতে মানুষের জন্য আর কোনো দ্বন্ধ সংঘাত কাম্য নয়। বিশ্বের বুক থেকে ক্ষুধা, দরিদ্রতা ও দুর্নীতি চিরতরে নিপাত যাক। ঘরে ঘরে প্রতিটি মানুষের জন্য কলম, কাগজ আর বই হোক দুর্দিনের হাতিয়ার। সাক্ষরতা হোক দক্ষ হয়ে জীবন তৈরি ও আগামির ডিজিটাল বিশ্ব গড়ে তোলার দুর্বার ও দুর্জেয় হাতিয়ার ।
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।