এ মুহূর্তে দেশে সবার কাছে পরিচিত একটি নাম আবরার ফাহাদ। বুয়েটের দেশসেরা এই মেধাবী ছাত্রটি এখন আর ইহকালে নেই। গত সপ্তাহে সতীর্থদের হাতে নির্মমভাবে খুন হবার পর সারাদেশ জুড়ে তার নাম। তার জন্য মানুষের অশ্রুপাত থামতে চাইছে না। অনেকের মতো নিজেও অশ্রু সংবরণ করতে পারি না। আবরার আমার ছেলের বয়সী উঠতি এক মেধাবী তরুণ। জানি না, তার বাবা-মার মনের অবস্থা এখন কেমন? তার দাদার আর্তনাদ গণমাধ্যমে দেখেছি। এমন বুকফাটা আর্তনাদ যে কারো হৃদয়কে বিচলিত করে। বুক ফেটে খান খান হয়। খুন হবার একদিন আগেও আবরারের এতো পরিচিতি ছিল না। ৭ অক্টোবর দিবাগত রাতে খুন হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার নাম দেশের ক'জন মানুষে জানতো? এখন সে বহুল পরিচিত এক নাম। তার জন্য সবার মনে কষ্টের বোঝা। এমন নির্মম খুনের ঘটনাটি যে কারো মনের অজান্তে অশ্রুপাত ঘটায়। মহনবী (স.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (র.) এর হত্যাকারী সীমার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পাষাণ বলে খ্যাত। আবরারের হত্যাকারীরা সেই সীমারকেও হার মানিয়েছে।
সতীর্থ বা সহপাঠী যে কোনো শিক্ষার্থীর আপন সহোদরের মতো। আমরা তো সেরকম জেনে এসেছি। শিক্ষাঙ্গন মায়ের কোল অপেক্ষা নিরাপদ জায়গা। আমরা সেভাবেই দেখেছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে বাবার চেয়ে বেশি কিছু। আমাদের শিক্ষকদের সে রকমই পেয়েছি। কিন্তু এখন? আবরারের নির্মম খুনের ঘটনা আমাদের টোটাল ধারণা পাল্টে দিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক আর সহপাঠী নিয়ে দিনে দিনে যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে- তাতে সত্যি উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
আবরার কোনো সাধারণ ছেলে নয়। অসাধারণ এক মেধাবী ছাত্রের নাম। এক হাজার ছেলের মধ্যে একজন আবরার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাকে নিয়ে পরিবার,দেশ ও সমাজ স্বপ্ন দেখতো। না জানি তার বাবা-মায়ের কী স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে? নিশ্চয় তাকে নিয়ে পরিবার অনেক বড় স্বপ্ন দেখতো। পাড়া-প্রতিবেশী ও গ্রামবাসী তাকে নিয়ে নিঃসন্দেহে গর্ব করতো। আবরারের মতো ছেলেদের নিয়ে দেশ ও জাতি আকাশ সমান স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন যারা হত্যা করে, তারা কারা? কারা এদের জন্ম দেয়? এরা কাদের সৃষ্টি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর বেশ গভীরে গিয়ে খুঁজতে হবে। তা না হলে এ জাতীয় হৃদয় বিদারক ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে। আবরারের মতো সোনার ছেলেরা বলির শিকার হতে থাকবে।
ঘরে ঘরে আবরারদের জন্ম হয় না। প্রতিদিন আবরাররা জন্ম নেয় না। আবরারদের মেরে ফেলা সহজ। জন্ম দেয়া কঠিন। আবরারের জন্য দেশ কাঁদে। কাঁদে জাতি ও সমাজ। কাঁদে মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধ। যে ছেলেগুলো আবরারকে খুন করেছে,তাদের কী ন্যূনতম মূল্যবোধ নেই? তাদের পরিবার কী তাদের সে শিক্ষাটুকু দেয়নি? তাদের স্কুল-কলেজ, তাদের শিক্ষকরাও কী তাদের মাঝে এতটুকু মানবিকতা জাগিয়ে দিতে পারেননি? বুয়েটে পড়তে গিয়েও তারা এতটুকু মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করতে পারেনি?তারাও তো কম মেধাবী নয়। মেধার সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে এরা বুয়েটে উঠে আসার সুযোগ পেয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মেধা জন্ম দিলেও নীতি-নৈতিকতা শেখাতে পারছে না। এ দায় কার? যারা খুনী, সে দায় কেবল তাদের একার নয়। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা, দেশ, সমাজ-সকলকে এর দায়ভার নিতে হবে।
আমাদের পারিবারিক বন্ধন দিনে দিনে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। বড়দের মেনে চলা আর ছোটদের স্নেহ-মমতা করার শিক্ষা পরিবারেই শিখেছি। পরমত সহিষ্ণুতা ও পরিবারেই শেখানো হতো। পরিবার ছিল শিশুর প্রথম আদর্শ শিক্ষালয়। পরিবার এমন এক বিদ্যাপীঠ, যেখানে শিশুদের মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠবার শিক্ষা দেয়া হতো। দৈনন্দিন ধর্ম-কর্ম পরিবারেই শেখানো হতো। আজকাল কেন জানি, নানা কারণে পরিবার আর আগের মতো ভূমিকা পালন করতে পারে না। আমাদের সমাজ বিজ্ঞানীদের সে বিষয়টির দিকে বেশি করে নজর দেবার সময় হয়েছে। তা না হলে প্রতিটি পরিবারে আবরারের ঘাতকেরা জন্ম নিতে থাকবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদ খুঁজে বের করতে হবে। শিক্ষা থেকে আমরা কী আউটপুট অর্জন করতে পারছি-সে চিন্তাটি আজ আমাদের বেশি করে ভাবতে হবে। তা না হলে আবরারদের বাঁচাতে পারবো না। আবরাররা দেশ ও জাতির সম্পদ। একজন আবরার দশটি পদ্মা সেতুর চেয়েও মূল্যবান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় গিয়ে আবরাররা হেরে যাবে কেন?
ছাত্র রাজনীতির নামে আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজকাল যা হয়ে থাকে, তা কী সত্যিকারের ছাত্র রাজনীতি? মাতৃভাষার জন্য ছাত্ররা সংগ্রাম করেছে। স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছে। ছয় দফা ও এগার দফায় দেশকে উত্তাল করেছে ছাত্র সমাজ। তাদের সেই গৌরবগাঁথা আন্দোলন সংগ্রামের কথা বলে বলে যারা ছাত্র রাজনীতির পক্ষে সাফাই দিয়ে বর্তমান নোংরা ছাত্র রাজনীতিকে জিইয়ে রাখছে, তারা দেশ ও জাতির চরম ক্ষতি করে চলেছে। আজকাল হল দখল,ক্যাম্পাসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা,অমুক নেতা-নেত্রীর মুক্তি দাবি, অমুক দল আর তমুক দলের লেজুড়বৃত্তি কিংবা র্যাগিংয়ের নামে যেসব আকাম-কুকাম হয়, সেসবকে আর যাই বলি না কেন, ছাত্র রাজনীতি বলা ঠিক হবে না। বললে ছাত্র রাজনীতির অতীত সোনালী ইতিহাস কলঙ্কিত হবে। যে ছাত্র রাজনীতি সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, বঙ্গবন্ধু কিংবা তোফায়েল আহমদ জন্ম দিতে পারে না ,সে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে কী হবে? গোল্লায় যাক বর্তমানের কথিত ছাত্র রাজনীতি। বুয়েটে আপাতত ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হয়েছে। দেশের সবগুলো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোংরা ছাত্র রাজনীতি উঠিয়ে দেয়া এখন সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি।
আমাদের স্কুল,কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেমন জানি হয়ে গেছে। ক্যাম্পাস আজ আর ভালোদের অভয়ারণ্য নয়। কবি শামসুর রাহমান আমাদের এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়কে 'ডাকাতদের গ্রাম' বলে অভিহিত করেছিলেন। সত্যি যেন হয়েছে তাই। বুয়েটে আবরারের সতীর্থরা যে কাণ্ডটি ঘটিয়েছে তা ডাকাতদেরও হার মানায়। কোনো ডাকাত দলও এমন নির্মম কাণ্ড ঘটাতে সাহস করবে না। জলজ্যান্ত একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে এক সাথে বসে খানাপিনা খাবে আর টিভির পর্দায় নাটক দেখবে। এদের এসব কাণ্ড দেখে ডাকাতরাও লজ্জা শরমের মুখ লুকোতে বাধ্য হবে।
মাদক আমাদের দেশ ও যুব সমাজকে একদম খেয়ে ফেলছে। মাদকের হাত থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে না পারলে আমাদের অস্তিত্বই একদিন চরম হুমকির মুখে পড়ে যেতে বাধ্য হবে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নাকি সন্ধ্যা হলেই মাদক সেবনের আড্ডা বসে। কেবল তরুণ ছাত্ররাই নয়, অনেক ছাত্রীও নাকি মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আবরারকে যারা হত্যা করেছে তারা সকলেই মাদকাসক্ত ও নেশাগ্রস্ত বলে মনে হয়েছে। এ বিষয়টি এখনি আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আমরা উন্মাদ ও নেশাগ্রস্ত জাতি বলে দুনিয়ার মানুষের কাছে কুখ্যাতি অর্জন করে বসবো। মাদকের বিরুদ্ধে জেহাদে নামার এখনই সময়। আমরা ধূমপান বর্জন করেছি বটে। এখন মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছি। আমরা পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হয়েছি। মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারবো না কেনো? সর্বাগ্রে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো মাদকমুক্ত করা অপরিহার্য।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৈন্যদশা এমন যে, পৃথিবীর নামীদামী এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। হায় কপাল! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান এতটা নিচে নেমে গেছে বুঝি? এ কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবরারদের নিরাপত্তা নেই। ক্যাম্পাসে আবরারের মতো মেধাবীরা অপাংক্তেয়। একদম অপয়া। যারা আবরারকে মেরেছে, এ জাতীয়দের দাপট এখন বুয়েটসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র ক্যাম্পাসগুলো বার বার কলঙ্কিত হয়। এদের কেউ দমাতে পারে না। না পারে সরকার। না পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পারবে কী করে? এরাইতো এদের লালন পালন করে। পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। নিজেদের স্বার্থে লালন-পালন ও পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। যখন কিছু একটা ঘটে তখন তারাই বড় গলায় প্রচার করে, 'এরা কারা? আমরা এদের চিনি না। এরা যে বা যারাই হউক তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে।' এরপর যেই লাউ সেই কদু। একদিন হৈ চৈ শেষ। আস্তে আস্তে সব ভুল পড়ে যায়। সবাই যার যার ধান্ধায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কে রাখে কার খবর? এভাবে অভিজিৎ, বিশ্বজিৎ, সাগর-রুনী, নুসরাতসহ আরও কত হত্যাকাণ্ডের বিষয় আমরা ভুলে যেতে বসেছি। এসব হত্যাকাণ্ডের আসামিরা এখন হয়ত বুক উঁচিয়ে চলাফেরা করে। এই হচ্ছে বাস্তবতা। এমন হলে আমরা আবরারদের কী করে বাঁচাতে পারবো? তাদের জন্য এক-দু'সপ্তাহ কেঁদে কেটে অশ্রুপাত করে কোনো লাভ নেই।
ভিসি বা উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তি। এই ভিসি নিয়োগে অনিয়মই এখন নিয়ম। রাজনৈতিক পরিচয় ভিসি মনোনীত হবার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। একটা সময় বিদগ্ধ পণ্ডিত, মেধাবী আর জ্ঞানী-গুণী মানুষ দেখে ভিসি নিয়োগ দেয়া হতো। আর আজকাল? ক্ষমতাসীন দলের সাথে যার যত লিয়াজোঁ আছে, তার তত ভিসি নিয়োগ পাবার সম্ভাবনা। ভিসিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত রকম অনিয়ম করে থাকেন, তার হিসেব কে রাখে? ইদানিং প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিদের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাবান্ধব ভিসি না হলে সে ক্যাম্পাসে আবরাররা নিরাপদ থাকে কীভাবে? গত সপ্তাহে এ নিয়ে দেশবরেণ্য কথা সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী ড. জাফর ইকবালের একটি লেখা দৈনিক শিক্ষায় পড়েছি। 'ভিসিদের জীবনকাহিনি' না কী যেন এক শিরোনামে তিনি একটি লেখা লিখেছিলেন। তাতে অতি চমৎকারভাবে বিষয়টি ফুটে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনের কোনো কোনো ভিসির নীতি-নৈতিকতা সাধারণ মানুষজনকেও সত্যি অবাক করে থাকে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি খায়েশ প্রকাশ করেছেন সুযোগ পেলে ভিসি পদ ছেড়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ নেবেন। এ নিয়ে গত দুইদিন ধরে চলছে আলোচনা-সমালোচনা, বিস্ময়। আবরার খুন হবার পর বুয়েটের ভিসি সাহেবের আচার-আচরণে কে না বিস্মিত হয়েছে? এসব ভিসিদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একেবারেই অনিরাপদ। তাই যদি হয়, তাহলে আবরারেরা কোথায় গিয়ে প্রস্ফুটিত হবে? নাকি এভাবে ফুটার আগেই তাদের ঝরে যেতে হবে।
লেখক : চড়িপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।