আবরার হত্যা : ২৫ জনকে আসামি করে চার্জশিট

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। বুধবার (১৩ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এই অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, এই ২৫ জনের মধ্যে ১১ জন আবরারকে হত্যায় সরাসরি অংশ নেয়। আর সেখানে উপস্থিতি এবং অন্যভাবে সম্পৃক্ততার কারণে বাকি ১৪ জনকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, শিবির হিসেবে সন্দেহের বিষয়টি ছিল আবরারের ওপর নির্যাতনের একটি কারণ। আসলে বুয়েট ছাত্রলীগের ওই নেতাকর্মীরা অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ‘উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত’ হয়ে গিয়েছিল।

পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার জসিম উদ্দীন জানান, অভিযোগপত্রে মোট ২১টি আলামত, ৮টি জব্দ তালিকা যুক্ত করা হয়েছে।

সিসিটিভি ফুটেজে আবরারকে নির্যাতনের পর ফেলে যাওয়ার ছবিবুয়েটের শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারকে গত ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।

পরদিন আবরারের বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ এজাহারের ১৬ জনসহ মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে। 

অভিযোগপত্র আদালতে জমা পড়ার আগে মিন্টো রোডে পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল।

তিনি বলেন, অভিযোগপত্রের আসামিদের মধ্যে ১৯ জনের নাম এজাহারেই উল্লেখ ছিল। পুলিশ তদন্তে নেমে আরও ৬ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে।

অভিযোগপত্রের ২৫ আসামির মধ্যে চারজন পলাতক। তাদের মধ্যে -জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মোর্শেদ এজাহারভুক্ত আসামি। আর মুজতবা রাফির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তদন্তে। 

মনিরুল জানান, অভিযোগপত্রে মোট ৩১ জনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে বাদীপক্ষের ৬ জন ছাড়াও বুয়েটের সাতজন শিক্ষক, ১৩ জন শিক্ষার্থী এবং ৫ জন কর্মচারী রয়েছেন।

এ মামলায় গ্রেপ্তার ২১ জনের মধ্যে আটজন ইতোমধ্যে আদালতে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন; তাদের সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।

আবরারকে কীভাবে ক্রিকেট স্টাম্প আর স্কিপিং রোপ দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল, সেই ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে এসেছে তাদের জবানবন্দিতে।

আবরারকে সেদিন সন্ধ্যার পর ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্যাতনের পর দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায় কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী। ভোরে চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সেদিন ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে জাজ মাল্টিমিয়ার তৈরি করা একটি ভিডিও দেখানো হয় পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে। 

মনিরুল বলেন, তদন্তকালে সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, রাত ১০টার পরে আবরারকে নির্যাতন করা শুরু হয় এবং রাত ২টা ৫০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এর আগে যদি তাকে হাসপাতালে নেওয়া হত তাহলে হয়তো এমন পরিণতি হত না।

আবরারকে নির্যাতনে ব্যবহৃত পাঁচটা ক্রিকেট স্ট্যাম্প, একটি স্কিপিং রোপ, দুটি সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিডি, পাঁচটি মোবাইল ফোন এবং একটি ল্যাপটপ এ মামলার আলামত হিসাবে রাখা হয়েছে।

আবরার নিহত হওয়ার আগে ফেইসবুকে তার শেষ পোস্টে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন।

বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই যে ফেইসবুকে মন্তব্যের সূত্র ধরে শিবির সন্দেহে আবরারকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা সংগঠনটির তদন্তে উঠে এলে ১২ জনকে বহিষ্কার করা হয়।

আবরারকে কেবল শিবির সন্দেহে ডেকে নেওয়া হয়েছিল, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল- সেই প্রশ্ন পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে করেছিলেন একজন সাংবাদিক। 

উত্তরে মনিরুল ইসলাম বলেন, একক কোনো কারণে নয়, শিবির করে এটি একটি মাত্র কারণ। ওরা এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ছোটখাটে বিষয়ে কেউ একটু দ্বিমত পোষণ করলে, কিংবা কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বললে, কিংবা সালাম না দেওয়ার কারণেও এই র‌্যাগিংয়ের নামে, মানে অন্যদেরকে, নতুন যারা আসবে, তাদের আতঙ্কিত করে রাখার জন্যই তারা এই কাজগুলো করে অভ্যস্ত।

তিনি আরও বলেন, এসব বিষয় হল বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেখার কথা। কিন্তু তদন্তে পুলিশ হল কর্তৃপক্ষের ‘এক ধরনের ব্যর্থতা’ দেখতে পেয়েছে। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা রাজনৈতিক পরিচয়কে শেল্টার হিসাবে ব্যবহার করেছে। তারা অছাত্রসুলভ আচরণ করেছে। ওই ছাত্রলীগকর্মীদের হাতে অনেকেই নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, “কেউ মামলা করতে চাইলে করতে পারে। তা তদন্ত করে দেখা হবে।

শেরেবাংলা হলের যে ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে নির্যাতন করা হয়, সেই কক্ষের আবাসিক ছাত্র বুয়েট ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহাকেও অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে, যদিও এজাহারে তার নাম ছিল না। 

এ বিষয়ে এক প্রশ্নে মনিরুল বলেন, অমিত সাহা এর আগেও একজনকে পিটিয়েছে। আবরারকে মারপিটের সময় সে উপস্থিত না থাকলেও তাকে ডেকে আনাসহ তার বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এ কারণে তাকে আসামির তালিকায় প্রথম দিকে রাখা হয়েছে।

আসামিদের অনেকে আদালতে জবানবন্দি না দিলেও পুলিশের কাছে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছে বলে জানান মনিরুল।

গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেনসহ ঊর্ধবতন কর্মকর্তারাও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে ১০ দফা দাবি তোলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও সমর্থন প্রকাশ করেন।

তাদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, আবরার হত্যার আসামিদের সাময়িক বহিষ্কার এবং হলগুলোতে নির্যাতন বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আন্দোলন শিথিল করে ১৪ অক্টোবর ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ দিয়ে মাঠের আন্দোলনে ইতি টানলেও হত্যাকারীদের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি চালিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা।

গত ১৯ অক্টোবর থেকে বুয়েটের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও আন্দোলনের কারণে তা এখনো হয়নি। পরীক্ষা শুরুর জন্য বুয়েট কর্তৃপক্ষ নিজেদের তদন্ত এবং পুলিশের অভিযোগপত্রের জন্য অপেক্ষার কথা জানিয়েছিল ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.013865947723389