আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই বাংলাদেশ স্বর্ণপদক পেয়েছে। ম্যানিলায় দুটি সম্মানজনক ও একটি কারিগরি পদকও অর্জন করেছে বাংলার সোনার সন্তানরা। আবারও প্রমাণ হলো আমাদের তরুণরা জয় করতে পারে, বিশ্বের কাছে দেশের মর্যাদা অটুট রাখতে পারে। ২০১৮ সালেই প্রথম অংশ নিয়ে সোনা জিতে এসেছে খুদে অলিম্পিয়াডরা।
ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় ২০তম রোবট অলিম্পিয়াডের ফলাফল ঘোষণা করা হয় ১৮ ডিসেম্বর। রোবট ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদকসহ চারটি পুরস্কার লাভ করে বাংলাদেশ। অভূতপূর্ব এ গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আট সদস্যের অংশগ্রহণকারী দলটি।
ক্রিয়েটিভ ক্যাটাগরি জুনিয়র গ্রুপে স্বর্ণপদক পেয়েছে চিটাগাং গ্রামার স্কুল (ঢাকা)-এর ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী কাজী মোস্তাহিদ লাবিব, তাফসির তাহরীম ও ম্যাপললিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মেহের মাহমুদের দল রোবোটাইগার্স। উল্লেখ্য, রোবট অলিম্পিয়াডের স্লোগান ছিল ‘সমুদ্র বাঁচাও’।
১৫ দেশের প্রায় ৮০০ প্রতিযোগীর সঙ্গে দুই ক্যাটাগরিতে লড়াই করে বাংলাদেশের অলিম্পিয়াডরা। ‘রোবট ইন মুভি’ জুনিয়র গ্রুপে দুটি ‘বিশেষ সুপারিশ’ পদক পায় বাংলাদেশ। প্রতিযোগীরা হলো রোবোটাইগার্স সানবীমস স্কুলের নাশীতাত যাইনাহ রহমান ও আগা খান স্কুলের যাহরা মাহজারীন পূর্বালীর দল রোবো চ্যালেঞ্জার্স।
স্বর্ণপদক জয়ী চিটাগাং গ্রামার স্কুলের (ঢাকা) রোবোটাইগার্সও এ ক্যাটাগরিতে এই সম্মানজনক পুরস্কার পায়। ক্রিয়েটিভ ক্যাটাগরিতে সিনিয়র গ্রুপে টেকনিক্যাল পদক পেয়েছে লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের খায়রুল ইসলাম ও ঢাকা কলেজের সানি জুবায়েরের টিম বাংলাদেশ।
ফিলিপাইনের ম্যানিলায় ১৫ থেকে ১৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের (আইআরও) ২০ তম আসরে অংশ নিতে ১৪ ডিসেম্বর ফিলিপাইনে পৌঁছায় বাংলাদেশ দল। পরের দিন ১৫ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। প্রথমে তাদের একটা ফায়ার ফাইটার বা সার্ভিল্যান্স রোবট সম্পর্কে লিখতে হয়েছিল।
তারপর পাঁচ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় মূল রোবটটি অর্থাত্ বোট আকৃতির রোবটটি বানানোর জন্য। বিচারকদের সামনে দুই মিনিটে প্রেজেন্টেশন দিতে হয় এবং এক মিনিট তাঁরা প্রশ্ন করেন। বাংলাদেশের ক্রিয়েটিভ জুনিয়র দল প্রেজেন্টেশনে অংশ নেয়। তাদের প্রেজেন্টেশনটিও বেশ ভালো হয়েছিল।
২০তম রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ থেকে আট সদস্যের প্রতিযোগীদের দলনেতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস ও মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপারসন লাফিফা জামাল। কাজী মোস্তাহিদ লাবিব ও তাফসীর তাহরীমের স্কুলে সামার ভেকেশন চলছিল।
তখন শুনতে পায়, স্কুলে সামার ক্যাম্প হবে রোবোটিকসের ওপর। দেরি না করে ওরা ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে। ক্যাম্পে রোবোট নিয়ে বেশ ধারণাও পায় তারা এবং রোবোটিকসের বিভিন্ন বিষয় শিখতে পারে। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় মো. মেহের মাহমুদ।
ক্যাম্প থেকেই জানতে পারে বাংলাদেশে রোবোট অলিম্পিয়াড হবে এবং সেখান থেকেই আন্তর্জাতিক রোবোট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের সুযোগ মিলবে। অলিম্পিয়াডের জন্য কঠোর পরিশ্রম শুরু করে এই তিন সদস্য।
প্রজেক্ট নিয়ে কাজী মোস্তাহিদ লাবিব বলে, ‘আমাদের যখন থিমটা দিয়ে দেওয়া হলো, তখন আমরা একটা ইউনিক আইডিয়া খুঁজেছি। যেমন— কমন একটা আইডিয়া, প্লাস্টিকের কারণে পানি দূষিত হয়; কিন্তু আমরা মূল প্রবলেমটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। তারপর একটি ফ্লাই বোর্ড দিয়ে বোট আকৃতির রোবোট বানাই।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারপারসন ও আন্তর্জাতিক রোবোট অলিম্পিয়াডের বিচারক ড. লাফিফা জামাল বলেন, ‘আমাদের দেশের বাচ্চারা প্রযুক্তির সবচেয়ে কম সহযোগিতা পেয়েও নিজের মেধা দিয়ে এত ভালো করেছে, এটা সত্যিই গর্বের।
আমরা যদি পর্যাপ্ত সুবিধা দিতে পারি, তাহলে তারা সব দেশকে ছাড়িয়ে সেরাটা অর্জন করবে। ভবিষ্যতে আমরা ১০টি ইভেন্টের সব কয়টিতেই অংশগ্রহণ করব। এ জন্য প্রয়োজন অব্যাহত সহযোগিতা। ’
বাংলাদেশ রোবোট অলিম্পিয়াডের কো-অর্ডিনেটর রেদওয়ান ফেরদৌস বলেন, ‘প্রথমে রোবোট ইন মুভি এবং তারপর একে একে অন্যান্য ক্যাটাগরির ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ভেবেছিলাম হয়ত ব্রোঞ্জ পেতে পারি।
যখন ব্রোঞ্জ পদক দেওয়া শেষ, ভাবলাম হয়ত সিলভার পাব। আবার যখন সিলভার পদক দেওয়া শেষ, তখন মনে হলো আমরা সম্ভবত কিছুই পাব না। তবে অর্গানাইজার কমিটি দূর থেকে আমাকে থাম্পস আপ দেখাচ্ছিল। তখন ভেবেছিলাম আমরা হয়ত কিছু একটা পাব। কিন্তু গোল্ড! এটা ধারণার বাইরে ছিল।
রোবোটাইগার্স ফ্রম বাংলাদেশ যখন ঘোষণা করা হলো, সবাই একসঙ্গে চিত্কার দিয়ে উঠল এবং দৌড়ে গিয়ে মঞ্চে ওঠে পুরস্কার গ্রহণ করে। অনুভূতিটা সত্যিই অসাধারণ ছিল।’
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে চীনের বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক রোবোট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেন রেদওয়ান ফেরদৌস। আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করার শর্ত হচ্ছে আগে দেশে একটি ন্যাশনাল অলিম্পিয়াড আয়োজন করতে হবে এবং সেখান থেকে সেরা প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।
২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর ন্যাশনাল রোবোট অলিম্পিয়াডের আয়োজন করা হয় এবং সেখানে ১২৬ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্য থেকে ৪২ জন গোল্ড, ব্রোঞ্জ ও সিলভার পায়। আয়োজক হিসেবে ছিল বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
বিজয়ীদের থেকে আটজন আন্তর্জাতিক রোবোট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। আন্তর্জাতিক রোবোট অলিম্পিয়াডে মোট ১০টি ক্যাটাগরিতে কম্পিটিশন হয় এবং প্রত্যেক ক্যাটাগরিতে দুটি ভাগ থাকে। ৭-১২ বছর বয়সীদের জন্য জুনিয়র গ্রুপ এবং ১৩-১৮ বছর বয়সীদের জন্য চ্যালেঞ্জ (সিনিয়র) গ্রুপ।
বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডসহ অনেক প্রতিযোগিতা আগে থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রোবোট অলিম্পিয়াডে প্রথমবার অংশ নিয়ে সোনা জয় সত্যিই অনেক আনন্দের। সুযোগ নয় অংশগ্রহণ করতে পারলেই যে ওরা জয় আনতে পারে তাই প্রমাণ হয়েছে।
আমাদের কিশোর-তরুণরা এখন অনেক এগিয়ে আছে বুদ্ধিতে, জ্ঞানের আলোতে। এইভাবে ওদেরকে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে, ওদের জানার-শেখার পরিধি বৃদ্ধি করতে পরিবারকে এবং দেশকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামলেখক
সৌজন্য: ইওেফাক