বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আরও এক আসামি মুজাহিদুর রহমান ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। রোববার (১৩ অক্টোবর) তিনি আদালতে বলেন, ‘আবরারকে আমিও স্কিপিং দড়ি দিয়ে পিটিয়েছি। তবে তাকে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে সবচেয়ে বেশি পিটিয়েছে অনিক সরকার। এ ছাড়া রবিন ও সকালসহ অন্যরাও চর-থাপ্পড় ও মারধর করেছে।’
এদিকে আগামী ১৩ নভেম্বরের মধ্যেই এ হত্যা মামলার চার্জশিট দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। চার্জশিটে ২৪ থেকে ২৫ জন সম্পৃক্ত হতে পারেন। তাঁরা সবাই বুয়েট ছাত্র। বেশির ভাগই বুয়েটের ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আদালত এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৩ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন।
সম্পৃক্ত বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আদালত এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৩ নভেম্বর ধার্য করেছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আগামি ১৩ নভেম্বরের মধ্যেই বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা মামলার চার্জশিট দেয়ার প্রস্তুতি চলছে।’ ডিবির অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই চার্জশিট দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তদন্ত সূত্র বলেছে, আবরার হত্যার ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ওয়াকিবহাল। তিনি ইতোমধ্যে বলেছেন, এই খুনের ঘটনায় জড়িত কেউ ছাড়া পাবে না। অন্যদিকে এই মামলার আসামিদের ইতোমধ্যে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাই চার্জশিট দিতে দেরি না করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান তারা।
ডিবি সূত্র জানিয়েছে, আবরার হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে এ পর্যন্ত চারজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা হলেন, বুয়েটের ছাত্র ইফতি মোশাররফ সকাল, মেফতাহুল ইসলাম জিওন, অনিক সরকার ও মো. মোজাহিদুর। এদের মধ্যে মোজাহিদুরকে রিমান্ড শেষে গতকাল আদালতে পাঠানো হলে কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তি দেন।
মুজাহিদের স্বীকারোক্তিতে রোমহর্ষক বর্ণনা: আবরারকে হত্যার দায় স্বীকার করে গতকাল রোববার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মুজাহিদুর বলেন, আবরার হত্যায় জড়িত সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ২০১১ নম্বর কক্ষে তাকে পরিকল্পিতভাবে ডেকে আনা হয়। ৬ অক্টোবর বিকেলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল আবরারকে সন্ধ্যার পর ডেকে আনতে নির্দেশ দেন। জেমি, মোয়াজসহ কয়েকজন তাকে ডেকে আনেন। রাত ৮ টার পর ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে আনার পর একে একে মেহেদী হাসান রবিন, তোহা মনির, রাফাত, বিল্লাহ, মাজেদ, মোয়াজ, অনীক, জেমি, তানভীর, তানিমরা আসেন। তারা আবরারকে অনেক প্রশ্ন করেন। তবে একসঙ্গে সবাই আসেননি। কয়েকজন আসেন আবার কয়েকজন চলে যান।
মুজাহিদ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে মেহেদী চড় থাপ্পর দিয়ে আবরারকে মারতে শুরু করেন। এরপর একজন ক্রিকেট খেলার স্টাম্প নিয়ে আসেন। সেটা দিয়ে মারধর করা হয়। সবাই মারেন। অনিক সরকার সবচেয়ে বেশি মারেন। সকাল, জিসান, তানিম, সাদাত, মোরশেদ বিভিন্ন সময়ে ওই কক্ষে আসেন ও আবরারকে মারেন। মোয়াজ, বিটু, তোহা, বিল্লাহ ও মুজাহিদ এবং তিনি নিজেও ওই কক্ষে দুই তিনবার যান। পর্যায়ক্রমে সবাই আবরারকে এরোপাতাড়িভাবে মারেন। রাত সোয়া একটা পর্যন্ত আবরারকে মারা হয়। এর মধ্যে কয়েকবার আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে কিছুক্ষণ মার থেমে থাকে। কিন্তু ঘুরে এসেই এক এক গ্রুপ আবার মার শুরু করে। এক সময় আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়লে তাকে কোলে করে তানিম, মেয়াজ, জেমি সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। পেছনে মোরশেদ, মুজাহিদ, তোহা, বিল্লাহ, মাজেদও ছিলেন। ইসমাইল ও মনির অ্যাম্বুলেন্স ডাকে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আসে না। তামিম ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসেন। পরে অ্যাম্বুলেন্সও আসে। কিন্তু ডাক্তার বলেন, ‘সে মারা গেছে’। জবানবন্দি শেষে মুজাহিদকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, আবরার হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের ১৫ জন এজাহারভুক্ত আসামি। বাকি চারজন এজাহারবহির্ভূত। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে চারজন এখনো গ্রেফতার হয়নি। এরা হলেন, মো. জিসান, মো. শাদাত, মো. মোর্শেদ ও মো. তানিম। এরা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে।
ঘটনায় কার কি ভূমিকা ছিল তদন্তে সে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে জানিয়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, আবরারের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে তার বর্ণনা উঠে এসেছে অনিক ও অন্যদের জবানবন্দিতে। এর আগে এই হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন ইফতি মোশাররফ সকাল ও মেফতাহুল ইসলাম জিওন। ইফতি জানিয়েছিলেন, আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে পিটিয়েছিলেন অনিক সরকার। একই কায়দায় অন্তত ২২ জন দফায় দফায় আবরারকে পেটান। ক্যান্টিনে রাতের খাবার খেয়ে এসে আবরারকে নিস্তেজ অবস্থায়ও ফের পেটানো হয়। রাত ১১টার দিকে অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এলোপাতাড়ি পেটান।
আরও পাঁচজন কারাগারে: পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে আরও পাঁচজনকে গতকাল কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশিদ। তারা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্না, সদস্য মুনতাসির আল জেমি ও খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাদের আর রিমান্ডের আবেদন জানাননি।
দুজন রিমান্ডে: আবরার হত্যা মামলায় গত শুক্রবার ও শনিবার গ্রেফতার হওয়া শামীম বিল্লাহ ও মো. মোয়াজকে গতকাল পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তাদের দশদিন করে রিমান্ড চেয়ে আবেদন জানালে মহানগর হাকিম পাঁচদিন মঞ্জুর করেন। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় থাকা শামীমকে শুক্রবার বিকেলে সাতক্ষীরা থেকে এবং শনিবার সকালে উত্তরা ১৪ নম্বরের একটি বাসা মোয়াজকে থেকে গ্রেফতার করা হয়।