হে কবি নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়/ বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়/ কহিল সে সিগ্ধ আঁখি তুলি/ দখিণ দুয়ার গেছি খুলি?/বাতাবী লেবুর ফুল ফুটেছি কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?/ দখিণা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল? কবি বেগম সুফিয়া কামাল তাহারেই পড়ে মনে বিখ্যাত গীতি কবিতায় এভাবেই বস্তকে স্মরণ করেছেন।
‘আম গাছে ধরল মুকুল নতুন শাখে শাখে/ ফাগুন তাকে সাজিয়েছে নতুন কনের সাঝে/ কত মাছি আসে ছুটে/ কত মধু নেয় যে চুষে/ কত পাখি গাইলো গান/ মুকুলের মন সজীব চঞ্চল’ কবি আবদুর রহমান আকনের ভাষায় আমের মুকুলের মন যেন সজীব চঞ্চল। বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি-সাহিত্যিকের হাতে বসন্ত আর আমের মুকুলের সৌন্দর্য রচিত হয়েছে।
সময়ের ভেলায় চড়ে নিয়মের নৌকা বেয়ে এ জনপদে প্রতিটি দুয়ারে বেশ আগেই নোঙর করেছে ঋতুরাজ বসন্ত। প্রকৃতিতে বইছে হিমেল পরশ আর মৃদু গরমের বসন্তের আবহাওয়া। বসন্ত মানেই ধরণীতে শিমুল-পলাশসহ হরেক রঙের ফুলের মেলা। এসময়ে গাছে গাছে দেখা যায় আমের মুকুল। ঝিম ধরা দুপুরে মুকুলের গন্ধ আর ফুলে ফুলে ভ্রমর-মৌমাছির ওড়াওড়ির দৃশ্য সত্যিই মনোহর। এমন দৃশ্য বাংলার গ্রাম-গঞ্জের পথে পথে হয়তো হরহামেশাই চোখে পড়ে। ইট-পাথরে গড়া ঢাকা শহরেও সত্তর-আশির দশকে এমন দৃশ্যের হয়তো দেখা মিলত। তবে এখন এ নগরীতে বসন্ত আসে শুধু ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে। বসন্তের কোনো আগুন রাঙা ফুল বা আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ দেখা যায় না বললেই চলে। তবে ব্যতিক্রম রাজধানীর ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস।
ঢাকা কলেজে এখনো বসন্তে ফুল ফোটে, কোকিল গান গায় আর প্রেমিক হৃদয়ে লাগে দোলা। এবারও বসন্তে নতুন সাঁজে সেঁজেছে ঢাকা কলেজ। ক্যাম্পাসের একাডেমিক ভবনের পাশে, পুকুর পাড়ে, উত্তর ও দক্ষিণ হল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হল এবং ইন্টারন্যাশনাল হলের সামনের আমগাছগুলো মুকুলে ছেয়ে গেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর আমের মুকুলে ভ্রমর-মৌমাছির ওড়াওড়ির দৃশ্য গ্রাম বাংলার ছবি হলেও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে এখন এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের দেখা মিলবে।
ঢাকা শহরের খুব কম স্থানই আছে যেখানে গ্রাম্য পরিবেশের স্বাদ পাওয়া যায়। আর তাইতো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অবিভাবক এমনকি পথচারীরাও মুগ্ধ এমন দৃশ্যে।
রাজধানীর আজিমপুর এলাকায় স্ত্রী, সন্তান, নাতি নাতনী নিয়ে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে বসবাস করেন ষাটোর্ধ্ব রেজাউল করিম। ঢাকা কলেজের টেনিস গ্রাউন্ডের আম গাছের মুকুলের দিকে তাকিয়ে রেজাউল করিম যেন হারিয়ে গেছেন তার ছোট্ট বেলায়। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস। শৈশবে যখন গ্রামে থাকতাম তখন আম গাছে মুকুলের দেখা মিললে আনন্দের শেষ ছিল না। গাছে আম ধরবে, কাঁচা-পাঁকা আম খেতে পারব। পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম হঠাৎ আমের মুকুল চোখে পড়ায় শৈশবের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। তাই কাছ থেকে দেখতেই এখানে আসলাম।’
স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ বলেন, ক্যাম্পাস ছুটি না হওয়ায় দীর্ঘদিন গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয় না। তাই বসন্তে গ্রামের সেই সৌন্দর্য এবার দেখা হলো না । তবে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে আম্র মুকুলসহ বিভিন্ন ফুলের সমাহার সেই দুঃখ কমিয়েছে অনকেটা। এই শহুরে এই জীবনে মনে একটু হলেও প্রশান্তি এনে দিয়েছে।