আলোচনা ব্যর্থ, ভিসি ফারজানার পদত্যাগ দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের পদত্যাগ চেয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

উপাচার্যকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য ১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেছেন, তা না করলে আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।

তবে আন্দোলনকারীদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বলেছেন, সরকারের নির্দেশ না পেলে তিনি পদত্যাগ করবেন না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলনকারী এই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন গত মাসে।

এর মধ্যেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে উপাচার্য ফারজানা ইসলামের কাছে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুজনকে সরতে হলেও তারা অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাদের তিনি অর্থ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এনিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার মধ্যে বুধবার বিকালে উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনায় বসেন জাহাঙ্গীরনগরের আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

প্রায় চার ঘণ্টার আলোচনা শেষে বেরিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’র মুখপাত্র অধ্যাপক রায়হান রাইন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তোলেন।

তিনি বলেন, “উপাচার্যের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগগুলো স্পষ্ট। ছাত্রলীগ কর্তৃক টেন্ডার ছিনতাইয়ের ঘটনার বিচার না করা, নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়া, প্রকল্পের টাকা নিয়ে কমিশন কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের চাঁদা দাবির ঘটনাকে দীর্ঘদিন গোপন রাখা।

“এছাড়াও কেন্দ্রীয় ও শাখা ছাত্রলীগের সাথে টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে নিয়ে গত ৮ ও ৯ আগস্টের বৈঠক সম্পর্কে মিথ্যাচার করা এবং টাকা ভাগ-বাটোয়োরার সাথে সরাসরি যুক্তদের স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও কোনো তদন্তের উদ্যোগ না নেওয়াসহ আরো বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে।”

দর্শন বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, বর্তমান উপাচার্যের তার নিজের পদে থাকার কোন নৈতিক অধিকার নেই। তাই আমরা তাকে পদত্যাগ করার দাবি জানিয়েছি। তবে তাকে সসম্মানে পদত্যাগের জন্য পহেলা অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এই সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করলে আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যাব।”

তার আগ পর্যন্ত নানা কর্মসূচি চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, এর অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার সাড়ে ১২টায় বিক্ষোভ মিছিল হবে।

তবে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, আগামী ২২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কোনো বিঘ্ন হবে না।

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, “ভর্তি পরীক্ষাকে কোনো রকম বিঘ্ন না করে আমাদের কর্মসূচি চলবে।

“কিন্তু যেহেতু আমরা বর্তমান উপাচার্যকে আর নৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে মনে করছি না, তাই ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন সব ভবনে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছি “

অন্যদিকে আলোচনা থেকে বেরিয়ে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ অমূলক। আমি কেন, কোনো উপাচার্য, কোনো প্রশাসনই সব কথা সবখানে বলতে পারে না। আমি যে কথা যে পর্যায়ে জানানো দরকার, সেখানে বলেছি।”


তিনি বলেন, “এটা বোঝাই যাচ্ছিল, তারা ঘুরে ঘুরে একটা জায়গায়ই আসতে চাচ্ছিল, সেটা হল আমার পদত্যাগ।

“তারা (আন্দোলনকারীরা) জানতে চেয়েছে, আমি বিচার বিভাগীয় তদন্ত করাব কি না? এ নিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিশেষজ্ঞের অভিমত নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের ১২ ধারা অনুযায়ী আমি তো নিজের সম্পর্কে নিজে কোনো বিচারের উদ্যোগ নিতে পারি না। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে উনাদেরই লিখিত আপিল দিতে হবে। কিন্তু সেটা তারা করবেন না। তারপরও আমি ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, অধ্যাপক ফারজানার কোনো অনিয়ম পেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পদত্যাগের আল্টিমেটামের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, “আইন অনুযায়ী এই পরিস্থিতিতে আমি পদত্যাগ করতে পারি না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কিংবা মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি নির্দেশ দেন, তবে সরে যাবো। যদি আমাকে নির্দেশ না দেন, তবে আন্দোলনকারীদের গালমন্দ খেয়েও আমাকে থাকতে হবে।”

ছাত্রলীগকে ‘ঈদ সালামীর নামে’ প্রকল্পের অর্থ থেকে দুই কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “জীবনে ৫০০ টাকার বেশি ঈদ সেলামি পাইনি। এত টাকা আমি দেব কোথা থেকে?”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় একনেক। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্য এ বছরের ১ মে ৬টি হলের দরপত্র আহ্বান করে কর্তৃপক্ষ। কাজের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দরপত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে।

এরপর ছাত্রলীগকে ‘ঈদ সেলামির’ নামে দুই কোটি টাকা চাঁদা দেওয়ার অভিযোগ উঠলে তিন দফা দাবিতে গত ২৩ আগস্ট থেকে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।

কয়েকদিন আন্দোলন চলার পরে গত ১২ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওই আলোচনায় আন্দোলনকারীদের দুটি দাবি মেনে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে প্রকল্পের টাকা নিয়ে দুর্নীতির তদন্তের দাবিটি অমীমাংসিত রেখেই শেষ হয় সেদিনের আলোচনা সভা।

দুর্নীতি অভিযোগের তদন্তের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বুধবার পর্যন্ত (তিন কার্য দিবস) সময় নেন উপাচার্য। সে অনুযায়ী পূর্ব নিধার্রিত সময়ে বুধবার আলোচনায় বসেছিল উভয় পক্ষ।

আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে উপাচার্যের সঙ্গে ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হক, ভারপ্রাপ্ত নিবন্ধক রহিমা কানিজ, প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কর্মকর্তা মাহতাব-উজ-জাহিদ, ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) আহসান হাবিব।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক উপ উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেন এই সভা বর্জন করেন। তিনি ক্যাম্পাসে উপাচার্যবিরোধী হিসেবে পরিচিত।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন,“আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে (উপ উপাচার্য) রয়েছি। কিন্তু গতকাল রাতে আমার মুঠোফোনের সংযোগ প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। আমি মনে করছি, এর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এর প্রতিবাদে আমি আজকের সভা বর্জন করেছি।”

অন্যদিকে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনকারীদের পক্ষে প্রায় ২২ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একটি প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিলেন।

আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন- পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান, রায়হান রাইন, এ এস এম আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া তপন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, তারেক রেজা প্রমুখ।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ছিলেন- ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয়, কার্যকরী সদস্য রাকিবুল ইসলাম রনি, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মারুফ মোজাম্মেল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দিদার, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) সভাপতি মাহাথির মোহাম্মদ এবং বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পক্ষে খান মুনতাসির আরমান, শাকিল উজ্জামান, জয়নাল আবেদীন শিশির ও আরিফুল ইসলাম।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003399133682251