আস্থার অন্বেষা ও শিক্ষক সমাজ

গোলাম কবির |

আমাদের ভেতর থেকে ‘আস্থা’ নামক অনুভূতি বোধ হয় অপসৃত। এই শব্দটির অর্থ সবার জানা থাকলেও নিজেকে উজ্জীবিত করার জন্য আবারও স্মরণ করি। ভরসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা ইত্যাদি হলো আস্থার আভিধানিক অর্থ। অধুনা এই বোধগুলোর অনুপস্থিতি এমনই প্রকট যে অনেকে বিষয়টি নিয়ে কলম ধরতে বাধ্য হচ্ছেন। ২১.৪.২০১৮ তারিখে ড. সা’দত হুসাইন সমাজের সর্বত্র আস্থাহীনতার বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচরে আনতে গিয়ে অনিবার্যভাবে সেখানে শিক্ষা ও শিক্ষক সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন কালের কণ্ঠে। আমরা তাঁর এই নিবিড় পর্যবেক্ষণকে সময়োচিত ও যথার্থ মনে করি।

শিক্ষা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার ভাবনা নতুন নয়। একসময় ছিল শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের অভাব নিয়ে। তারপর যথাযোগ্য নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে অনুসন্ধিত্সুকে ভাবিত করেছে। এখন কিছু শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কর্মকাণ্ড শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

একটি জাতিকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি জোগায় যথার্থ শিক্ষা। যার কাণ্ডারি হবেন ব্রতী শিক্ষক। এঁদের সন্নিধানে গড়ে ওঠা শিক্ষিত মায়ের সন্ধান করেছেন নেপোলিয়ন, শুদ্ধজাতি গড়ে তোলার জন্য। এ পি জে আব্দুল কালাম মনে করতেন, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জাতি গঠনের অন্যতম কারিগরদের মধ্যে প্রধান হলেন পিতা-মাতা ও শিক্ষক।

শুদ্ধ মানুষ তৈরির জন্য আদর্শ পিতা-মাতা নিয়ামক হলেও ব্রতী শিক্ষকের অবদান বোধ করি কম নয়। তাই শিক্ষকদের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন আব্দুল কালাম। তিনি কঠোর পরিশ্রমী পিতা-মাতার সান্নিধ্যে লালিত হয়েছেন এবং যেসব শিক্ষকের কাছে তাঁর শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়েছে, তাঁরা ছিলেন প্রবাদপ্রতিম। একটি বিশ্বাস্য সত্য পাশ কাটিয়ে যাওয়া কঠিন যেকোনো উদীয়মান জাতির শিক্ষক সমাজের বেশির ভাগই যখন বিনষ্টের পথ ধরে ওপরে ওঠার ধান্দায় মত্ত থাকে, তখন সে সমাজের ভরাডুবি রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অপেক্ষাকৃত সুলভ কর্মসংস্থান হিসেবে শিক্ষকতার চাকরির সুযোগ পেয়ে শিক্ষক নামের চাকুরেদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও আদর্শ ভুলে যান। কত সহজে গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়া যায় অথবা অবস্থানের মগডালে ওঠা যায়, তাই নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। আদর্শ পদদলিত হয়। তখন শিক্ষকতা বেতন প্রাপ্তির নিমিত্ত হয়ে ওঠে। সমাজে এমন ভয়াবহতা সৃষ্টি হলে সবার আঁতকে ওঠার কথা। দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজের কর্তাব্যক্তি ও বিত্তবানদের এ নিয়ে উদ্বেগ শূন্যের কোঠায়। কারণ তাঁদের সন্তান-সন্ততি অধিকতর বিত্ত সংগ্রহের স্বপ্নে উন্নত দেশে পাঠগ্রহণ করছে। আমরা অভাজনরা অধোগামী শিক্ষার পরিবেশের সঙ্গে ঝুঁকছি। আর কিছু মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে সনদ কেনায় ব্যস্ত।

শিক্ষককে ফেরেশতা বা দেবতা হতে হবে তা নয়। তবে শিক্ষক সম্পর্কে চিরাচরিত যে ধারণা অনুসরণ করলে হয়তো আমাদের সমাজে অধুনা শিক্ষকের প্রতি আস্থাহীনতার অবসান হতো।

জ্ঞান সাধনার ইতিহাস শিক্ষক সক্রেটিসকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রেখেছে। তাঁর অনমনীয় সত্যনিষ্ঠার জন্য। হেমলক পানে তাঁর নশ্বর দেহ ধুলায় মিশে ধূলি হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁর কীর্তি মহাকাল ধরে রেখেছে, ঘোষণা করছে ‘জয় জয় হে মানব’ এবং প্রমাণ করেছ ‘আপনি আচরিধর্ম অপরে শেখাও’। ইমাম আবু হানিফা নীতি বিসর্জন দেননি বলে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। আমাদের দেশে এখনো কিছু শিক্ষক জীবিত আছেন, যাঁরা হালুয়া-রুটি কিংবা একখণ্ড মাংসের জন্য সত্যভঙ্গ হননি।

নজরুল ইসলাম ‘আগের মানুষ কই’ বলে একটি গানে আফসোস করেছিলেন। এখন আমাদের বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে, ফেলে আসা দিনগুলোর সেই ব্রতী শিক্ষক কই!

আমরা সেকেলে মানুষ। এখনো আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরের শিক্ষকদের নিয়ে গর্ব করি। তাঁদের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। এখনকার শিক্ষার্থীদের বোধ করি তেমনটি হয় না। তাদের কাছে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ‘চাল দিয়ে ভাত খাই, তুমি কি আমার পর’ প্রবাদের মতো। শিক্ষকের আদর্শ-নিষ্ঠার দারুণ অভাব। শিক্ষক নামের এসব প্রজাতি সময়কে পায়ে ঠেলে। মাস কখন শেষ হবে তাই নিয়ে প্রতিনিয়ত ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায়। এদের প্রতি আস্থা রাখা কতখানি সহজ!

বঙ্গবন্ধু আস্থাবান শিক্ষক সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্ন-বস্ত্রের সরকারি ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই সৈয়দ মুজতবা আলী সৃষ্ট দুস্থ শিক্ষকের মতো এখনকার শিক্ষকদের আর ক্ষুব্ধ-বিষণ্ন হতে হয় না। দুঃখের বিষয়, পাত্র-অপাত্র শিক্ষকতায় এসে শিক্ষক সম্পর্কিত শ্রদ্ধাবোধ অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষককে দেখেও দেখতে পায় না। আবার সামনাসামনি আসতে অচেনার ভান করে।

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টে শিক্ষকদের কিছু স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সদ্ব্যবহার করেননি। স্বার্থান্বেষণ এবং দলবাজি তাঁদের প্রধান চালিকাশক্তি। উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য কখনো ক্ষমতার পদলেহন করেন আবার হাওয়া বদলের আভাস অনুমান করে বিপরীত স্রোতে ভেসে যান, হেগেলের ডায়ালেক্টিক প্রসেসের মতো, এ অবস্থার মূল কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল মেধার ব্যক্তিদের অনেক সদস্য শিক্ষকতায় আসীন বলে, তাঁরা আস্থাবান ও অনুকরণীয় হয়ে উঠছেন না।

জৈবিক ব্যাপারে প্রাণীর বাছ-বিচার নেই। মানুষের থাকা বাঞ্ছনীয়। তেমনই রিপুর তাড়না সব মানুষের সমান থাকলেও শিক্ষক সমাজ হবে ব্যতিক্রম। সেখানেই বিচলিত বিভ্রান্ত মানুষ আস্থা খুঁজে পাবে হয়তো।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030779838562012