স্কুলপড়ূয়া এক ভাগ্নি আছে আমার, বয়স ১২। শিশু হলেও তার ছোট্ট মাথায় স্বাধীন চিন্তা ঘোরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার জন্মদিনের মিল আছে; এতে সে আহ্লাদিত। আমার আম্মার কাছে গল্প শুনে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ভক্ত হয়েছে। গত বছর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ওপর স্কুলে দেয়াল পত্রিকা করে পুরস্কার জিতেছে। এবার সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতে একদিন বলল, 'মামা, তুমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে পার না- আমাদের দুই সেট করে বই দিতে। এক সেট বই স্কুলে থাকবে, আরেক সেট বাসায়। তাহলে স্কুলের ব্যাগটা এত ভারী হবে না। আমার মতো ছোটদের স্কুলব্যাগ নিতে কষ্ট হবে না।'
মাঝেমধ্যে স্কুলযাত্রার সঙ্গী হওয়ায় লক্ষ্য করেছি, তার স্কুলব্যাগ ভীষণ ভারী। কাঁধে ঝুলালে ব্যাগের ভারে নুয়ে পড়ে, হাঁটতে কষ্ট হয়। চাইলেও স্কুলব্যাগটা দেয় না। আমাকে বোঝায়, ছাত্রী হিসেবে এটা তার কাজ। অকাট্য যুক্তি, আমি হার মানি। তবে তার কষ্টটা পীড়া দেয় আমাকে। একদিন মেপে দেখি, টিফিন বক্স ও পানির ফ্লাস্ক ছাড়াই ভাগ্নির বই-খাতাভর্তি স্কুলব্যাগের ওজন ৭ কেজি সাড়ে ৬শ' গ্রাম। একজন যুবকও আট কেজি ওজনের ব্যাগ নিয়ে পথ চলতে হাঁপিয়ে ওঠে।
স্কুলে এক সেট বই রাখার পক্ষে আরও যুক্তি আছে ভাগ্নির- সহপাঠীদের অনেকে বই হারিয়ে গেছে, বাসা থেকে আনতে ভুলে গেছে, তাই হোমওয়ার্ক করতে পারেনি, পড়া করতে পারেনি- এমন নানা অজুহাতে স্কুল ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। সেটা বন্ধ হবে। শুধু দরকার হবে স্কুলে বই রাখার লকার।
প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত পৌঁছানোর সামর্থ্য আমার নেই। ফেসবুকে লিখে দিয়ে ভাগ্নিকে সান্ত্বনা দেব ভেবেছিলাম, তাও করিনি। তবে ভাগ্নির চিন্তাটা মনে ধরেছে। আবার এটাও ভেবেছি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল ও আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে বিনামূল্যে এক সেট করে বই দিতে প্রতি বছর জনগণের হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে সরকার। দুই সেট দিতে খরচ দ্বিগুণ হবে। ফলে এই আবদার শোভন নয়। তবে স্কুলগুলো বই রাখার সুযোগ দিলে, যাদের সামর্থ্য আছে তারা বাচ্চাকে অতিরিক্ত এক সেট বই কিনে দেবে হয়তো। এমন আয়োজন ভাবা যেতে পারে। তাতে বহু ছোট্ট শিশুর কষ্ট দূর হবে। ভারী স্কুলব্যাগ বহনের ক্লান্তি পড়ালেখার আনন্দ, উদ্দীপনা আর স্পৃহাকে গ্রাস করতে পারবে না।
এমন অনেক ভারে স্কুলের বাচ্চারা অনেক বছর ধরে বিরক্ত; তা বোঝা গেল এবারের নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর পরিচিতদের স্কুলপড়ূয়া ক'জন বাচ্চার সঙ্গে গল্প করে। ওরা রাজনীতি বোঝে না। কিন্তু বিগত ১০ বছরের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাদ হওয়ায় বেজায় খুশি। তাদের ভাষ্য- আগের শিক্ষামন্ত্রী প্রাথমিক স্কুল সমাপনী-পিইসি এবং নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল সমাপনী সনদ-জেএসসি পরীক্ষার নামে তাদের ওপর পড়ালেখার অপ্রয়োজনীয় ভার চাপিয়েছেন। বাচ্চাদের কথায় মনে পড়ল, ২০১৬ সালে সরকার বলেছিল- প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করবে। কিন্তু আজও হয়নি। অথচ শিশুদের পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিতর্কিত। এসবের প্রবর্তন প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। কোনো যথার্থ শিক্ষা গবেষণা বা শিক্ষানীতির আলোকে অনেক কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। বিগত ১০ বছরে বাচ্চাদের প্রশ্নপত্র তৈরি, প্রশ্নের ধরন, পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এমন অনেক কিছু হয়েছে, যা দেখেশুনে এমন ধারণা তৈরি হওয়া অবান্তর নয়- শিক্ষা যেন জাতির জন্য গৌণ ব্যাপার।
জাতীয় নির্বাচনের ৫৫ দিন আগে ৪ নভেম্বর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের নেতারা, যারা দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন, প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিলেন। এ জন্য সেদিনের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে (যদিও সরকার বলেছে অনিবার্য কারণ। কিন্তু তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি); পরে শুক্রবার ছুটির দিন তা নেওয়া হয়েছে।
ভোটের দেড় মাস পর আবারও একই ঘটনা। দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বিবাদে লিপ্ত থাকার কারণে এবার বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন অনিশ্চিত হয়। শেষে সরকারি সমঝোতায় পিছিয়ে ফেব্রুয়ারিতে এসেছে। তাই বলে বহু আগে থেকে পরিকল্পনা করে নির্ধারিত এসএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে! ইজতেমার জন্য এসএসসির তিন দিনের (১৬, ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি) পরীক্ষা পিছিয়ে এ মাসের শেষে নেওয়া হয়েছে। এসএসসি স্কুল সমাপনী পরীক্ষা। একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী বাকি জীবনে যত পড়ালেখা করে, চাকরি করে বা যে কোনো পেশাগত জীবনে যায়, সেখানে তার এই পরীক্ষার সাফল্য-ব্যর্থতা গণ্য হয়। সে জন্য শুধু একজন পরীক্ষার্থী নয়; তার গোটা পরিবার এই মাসব্যাপী পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নেয়। যার মধ্যে মানসিক প্রস্তুতিও আছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার সূচি মাথায় রেখে চলে সেসব প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা। ফলে সূচিতে হঠাৎ পরিবর্তন পরীক্ষার্থীর মানসিক ছন্দের পতন ঘটায়। আমি শিক্ষার গবেষক নই, মনস্তত্ত্ববিদও নই। কিন্তু আমিও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম, তাই আমি জানি। এসএসসি পরীক্ষার পর ইজতেমা করলে কী ক্ষতি হতো, তা একেবারেই বোধগম্য নয়? আমরা কেউ তো ইজতেমা এবং হেফাজত ও কওমি মাদ্রাসা নেতাদের প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়ার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এসব আয়োজন কেন লেখাপড়া ও পরীক্ষার সঙ্গে আপস করে করতে হবে- এই প্রশ্নটি তোলার মতো সৎ সাহসও যেন অনেকে হারিয়ে ফেলেছেন! ভয়টা কিসের?
বছর দুই আগেই হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী নাটকীয়ভাবে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অনেক কেন্দ্রে একাধিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ভুল প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। যারা প্রশাসনে বসে এসব করছেন, শিক্ষা নিয়ে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাদের কর্মকাণ্ড দেখে কারও মনে হতেই পারে, সংবিধানে জাতির মৌলিক অধিকার শিক্ষা তাদের কাছে ছেলেখেলা। এ-ই যখন অবস্থা তখন বাচ্চাদের স্কুলব্যাগের বোঝা কমাতে আরেক সেট বই স্কুলে রাখার দাবি স্বপ্নবিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
কেউ কারও বিরাগভাজন হবেন, কারও স্বার্থহানি ঘটবে, কারও সুযোগ-সুবিধা কমে বা বন্ধ হয়ে যাবে, কেউ কারও রোষানলে পড়তে পারেন- এমন নানা কারণে বহু ন্যায্য কথা যে অনেকেই বলছেন না- সেটা অতি সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে। অনেকে দীর্ঘকালের প্রতিষ্ঠিত সত্যকেই পাল্টে দিচ্ছেন, মিথ্যা বলছেন। সেসব ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনা না টেনে এটুকু বলি, শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু- এই কৌশলে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে দমন করতে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আরেক উগ্র সাম্প্র্রদায়িক দলকে বন্ধু করেছে ক্ষমতাসীনরা। তাদের কওমি মাদ্রাসার সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের ইচ্ছা পূরণ আমাদের স্কুলের পড়ালেখায় প্রভাব ফেলছে। অথচ জামায়াত, হেফাজত, ইসলামী ঐক্যজোটসহ এ ধরনের সব দলই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। তারা সবাই উগ্রবাদ প্রচার করে, অসাম্প্র্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়, উন্মাদনার চাষ করে। ফলে রাজনীতির মাঠের আজকের নানা কৌশল বাংলাদেশের জন্য আসলে কতটা ভালো ফল আনবে, নাকি খারাপ ফল- তা দূর ভবিষ্যৎ বলে দেবে। আজকের স্কুলপড়ূয়া শিক্ষার্থীরা বড় হয়ে এসব সিদ্ধান্তের কুফল বা সুফল ভোগ করবে, যেমন আমরা এখন ভোগ করছি আমাদের শৈশব, কৈশোরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা-পরবর্তী জিয়া ও এরশাদের সেনা শাসনের সময় বোনা সাম্প্র্র্রদায়িক বীজের কুফল।
সবশেষে ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতা বলি। বিগত কয়েক দশক ধরে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ, সাম্প্র্রদায়িকতা, ইসলাম ধর্মকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করায় বহু কওমি মাদ্রাসার নেতা, শিক্ষক, ছাত্রের (তারা নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে) সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। অনেক কিছু জানলেও এখানে লিখছি না। তবে এটুকু না বললেই নয়; ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ভাঙার পর সাভারে এক কওমি মাদ্রাসার ১০-১২ বছরের এক দল ছাত্রের সঙ্গে এক বিকেলে গল্প করতে বসেছিলাম। ওরা জানাল, তাদের মাসিক বেতন দিতে হয় ১০০ টাকা। কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে স্কুলে পড় না কেন? ছোট্ট শিশুরা উত্তর দিল- 'স্কুলে শয়তানের শিক্ষা দেয়।... মাদ্রাসায় দ্বীনের শিক্ষা দেয়?'
ছোটবেলায় শিখেছিলাম শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সাম্প্র্রতিক কর্মকাণ্ড নতুন ভাবনা ভাবাচ্ছে- নতজানু শিক্ষা কি তবে জাতির নতজানু মেরুদণ্ড তৈরি করে?
সূত্র: সমকাল