একটা দ্বিভাষিক সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছিলাম কিছুদিন। সেখানকার অনেক কিছুই অন্য রকম হবে স্বাভাবিক, তবে সবচেয়ে বিস্ময়ের ছিল কর্মীকে মূল্যায়নের রীতি। ‘ও ইংরেজি পারে না’ অথবা ‘নট গুড অ্যাট ইংলিশ’ এ রকম বাক্য শোনা যেত চারদিক থেকে। মানে পরিষ্কার, ইংরেজি যে পারে না সে আসলে ভালো না। বোধ-চিন্তা-কর্মদক্ষতা সব ছাপিয়ে পাল্লায় উঠত ইংরেজি জ্ঞান এবং তাতে খেই হারিয়ে অনেক কর্মঠ কর্মীও গণ্য হতেন নিকৃষ্ট হিসেবে। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, সেই সুযোগে পরিচয়ও হলো পুরোদস্তুর ইংরেজি মাধ্যমে পড়া কিছু তরুণ-তরুণীর সঙ্গে। এর মধ্যে একজন অফিসে নিয়ে আসত একটা গিটার। কাজের ফাঁকে কয়েক পাক গিটার বাজিয়ে নিত। আরেকজন কয়েক দিন আসছে না। জানা গেল, ওর গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আসা সম্ভব হচ্ছে না।
আরেকজনকে কেউ একজন একদিন বইমেলায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল। সে জানতে চাইল, ‘বইমেলা! হোয়ার?’
‘বাংলা একাডেমিতে।’
‘বাংলা একাডেমি! হোয়ার?’
‘টিএসসির পাশে।’
‘টিএসসি! হোয়ার?’
এই পক্ষ এবার স্তম্ভিত, ‘ঢাকা ভার্সিটিতে।’
‘ভার্সিটি! হোয়ার?’
এমন মানুষকে খেলা কিংবা মেলায় নেওয়া যায় না বলে সে আলোচনা এখানেই থামল।
আরেকবার অফিসের এক কর্মী এক গোছা ধানের শীষ নিজের ঘরে লাগিয়ে রেখেছিলেন। সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে। দেখে একজন বলল, ‘উফ! এই জিনিসটা বাংলাদেশের কোন একটা দলের যেন নির্বাচনী প্রতীক? কোন দল যেন!’
চাইলে যে কেউই ওকে উত্তরটা দিতে পারত কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসকারী কেউ ধানের শীষ কার প্রতীক সেটা জানে না দেখে বিস্ময়ে সবার মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এ রকম বিস্ময়ের ব্যাপার প্রতিদিনই এক-আধটা ঘটত। অনেকেই ওদের নিয়ে হাসাহাসিও করত; কিন্তু ভেবে দেখলাম এই দোষটা তো ওদের নয়। ওরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে, অতি সচেতন মা-বাবা সব সময় খেয়াল রেখেছেন যেন এ দেশের নোংরা পরিবেশে ওরা দূষিত না হয়ে পড়ে। তাই বাংলা পড়েনি। বাংলাদেশকে চিনেনি। গাড়ি ছাড়া চলেনি। আর মজার ব্যাপার ওদের নিয়ে হাসাহাসি করাদের অনেকেই তলে তলে ইংরেজির প্রেমে মশগুল। নিজের বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পাঠাচ্ছে। বাংলা ভোলাচ্ছে। ইংরেজি শেখাচ্ছে। এই বৈপরীত্য বিস্ময়কর কিন্তু এর পক্ষে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বও আছে। ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এখনো আমাদের মন আর মনস্তত্ত্বে অবচেতনে জুড়ে রয়েছে সেই ভাবনা। ইংরেজি অভিজাতদের ভাষা। ইংরেজি শিখলে তুমি অভিজাত। না হলে ছোট জাত। আর তাই বোধ হয় মেয়র ইংরেজি ঠিকঠাক বলতে না পারলে বিদ্রুপের শিকার হন। তার মেয়রত্ব এই ভাষাজ্ঞান দিয়ে মেপে ফেলার একটা চেষ্টা চলে। আবার মেয়র ইংরেজিতে চোস্ত না হলেও ইংরেজিতেই ভাষণ দিতে যান। কারণ তাহলে কিছু পয়েন্ট যোগ হয় বলে ধারণা।
দ্বিতীয় ভাষা শেখার দরকার অবশ্যই আছে। কিন্তু এখানে শুরুতেই যে প্রশ্নটা মাথায় আসে, ইংরেজি, বিশেষত বলার ইংরেজির ক্ষেত্রে আমাদের এই দুর্বলতা কেন? আরো কয়েকটা ইংরেজ শাসিত দেশ ঘুরে দেখেছি, সেখানে কাজ চালানোর মতো ইংরেজি প্রায় সবাই পারে। আমরা পারি না। আমাদের সর্বোচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষও ইংরেজি বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে হাস্যকর হয়ে ওঠেন। আবার আমরা হাসাহাসি যে করি তা-ও কি ঠিক! ইংরেজি না বলতে পারা মানুষও তো বিজ্ঞানে-অঙ্কে দারুণ দক্ষ হতে পারেন। সমাজে ইংরেজির চর্চা এবং ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে মূল্যায়ন সব কিছুর মধ্যেই, তাই চিন্তাগত একটা বিভ্রান্তি আছে। পুরো বিষয়টা একটা ধাঁধা। আর এ রকম ধাঁধায় বাধা পড়লে জাভেদ ভাইয়ের সাহায্য নিই সাধারণত।
জাভেদ ভাই বলল, ‘ইংরেজি যে আমরা বলতে পারি না এর মূলে আছে ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে ভুল চিন্তা।’
কিছুটা বুঝি। পুরোটা বুঝতে জানতে চাই, ‘ভুল চিন্তাটা একটু ব্যাখ্যা করো।’
‘আমাদের শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় ইংরেজি ব্যাকরণ শেখা। ইংরেজি লেখা। ফলে হয় কী, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষ দেখবে ইংরেজিতে একটা দীর্ঘ চিঠি হয়তো লিখে ফেলতে পারবে, ইংরেজি পত্রিকাও দিব্যি পড়ছে কিন্তু বলতে পারছে না।’
‘ব্যাকরণ শেখার দরকার আছে না?’
‘তা আছে, তবে সেটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা বলাটার ক্ষেত্রে গুরুত্বটা কম দিই। অথচ সেটারই বেশি দরকার। ধরো, সাধারণ একজন মানুষ ওর তো ইংরেজি ব্যাকরণ জানার দরকার নেই। দরকার বলা এবং বোঝা। সে জন্য দরকার চর্চা। আমাদের শিক্ষায় ইংরেজি বলার চর্চা নেই, সমাজে-পরিবারেও নেই, তাই ইংরেজি শেখা হয়, ইংরেজি বলা শেখা হয় না।’
মেনে নিয়ে বললাম, ‘ঠিক। ইংরেজি বলায় পিছিয়ে থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে আছি। এখনকার মা-বাবা যে বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়ামে ঠেলছে, সেটার জন্য ওদের সেভাবে দোষ দেওয়া যায় না।’
জাভেদ ভাই ভেবে বলে, ‘এখানেও ভ্রান্তি আছে।’
‘কী ভ্রান্তি?’
‘আমি ভুলও হতে পারি কিন্তু ইংরেজি শেখা আর ইংরেজি মাধ্যমে পড়া দুটো বোধ হয় এক নয়। ইংরেজি মাধ্যমে পড়লে একজন সেই সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠে। থাকছে বাংলাদেশে আর বড় হচ্ছে বিদেশের আবহে—তাতে ওদের সমাজবিচ্যুত হওয়ার একটা আশঙ্কা দেখা দেয়। তা ছাড়া একটা উচ্চম্মন্যতাও তৈরি হয়। ওরা বিদেশে চলে গেলে ঠিক আছে; কিন্তু দেশে থাকলে দুই পক্ষেরই সমস্যা। ওরাও সমাজে যুক্ত হতে পারে না। আবার ওদের কাছ থেকে সমাজ বা দেশও প্রত্যাশিত সেবা পায় না।’
‘তা ঠিক কিন্তু ইংরেজি তো শিখতে হবে। ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া উপায় কী?’
‘শিক্ষাবিদরা আরো ভালো বলতে পারবেন; কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম খুব ভালো উপায় বোধ হয় না। ধরো, ইংরেজি মাধ্যমে যে চোস্ত ইংরেজি মানুষ শেখে সেই ইংরেজি কাজে লাগে কোথায়? ইংল্যান্ড-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে আবার ওদের ইংরেজির কাছে আমাদের সর্বোচ্চ শিক্ষার ইংরেজিও তুলনামূলক দুর্বল। তবু সেখানে এরা গুরুত্ব পায় কিন্তু এর বাইরে তো এই স্মার্ট ইংলিশ খুব কাজে লাগে না।’
‘কাজে লাগে না! কেন?’
‘ধরো, তুমি ইউরোপে গেছ, ওদের ভাষা পারো না বলে ইংরেজিতেই চালাতে হবে। দেখবে বেশির ভাগ মানুষ ইংরেজি পারে না, যারা পারে ওরা ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি, মানে তুমি-আমি যে ইংরেজি শিখি সেটাই বরং ওখানে বেশি কাজের। আরব বিশ্ব বা দক্ষিণ আমেরিকাতেও তাই। সেখানে তোমার ইংরেজি মাধ্যমে শেখা চোস্ত ইংরেজি ওদের বেশির ভাগ মানুষ বুঝবেই না। ওরাও বলে ধাক্কানো ইংলিশ, তুমিও সেটা বললে ওদের সমতায় থাকবে।’
‘তাই তো। এভাবে তো ভাবিনি কখনো। চীন-জাপানে দেখেছি ওরা কোনোভাবে ইংরেজি বলে এবং আমাদের কোনোভাবে বলা ইংরেজি বেশ বুঝে নেয়। একটু কঠিন ইংরেজি বললেই আর পারে না।’
‘তার মানে কী?’
‘মানে ইংরেজি মাধ্যম খুব জরুরি নয়।’
‘এবং জরুরি নয় ইংরেজির জাহাজ হওয়া কিংবা একেবারে ব্রিটিশ উচ্চারণের ইংরেজি শেখা। জরুরি হলো ইংরেজি বলতে পারা। আর সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় স্পোকেন ইংলিশের ওপর বরং বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে একজন শিক্ষিত মানুষ মাত্রই ইংরেজিতে কথা বলতে পারবে।’
জাভেদ ভাই কোনো শিক্ষা গবেষক নয়। তার ভাবনায় ভুলও থাকতে পারে কিন্তু আমাদের শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা কি ভাষা শিক্ষাটা নিয়ে এভাবে ভেবেছেন! তাঁরা ভাবলে নিশ্চয়ই আরো উন্নত, আরো পরিশুদ্ধ প্রক্রিয়া বের হবে।
হয়তো এসব ছোট ভাবনা বলে তাঁরা ভাবছেন না। বড় বড় বিষয় শেষ করে শেষে একদিন এই কাজে আসবেন। আমরা সেই দিনের অপেক্ষা করি। আর আপাতত ভাষা নিয়ে একটা রসিকতা শুনি।
তারাপদ রায়ের বিশাল সংগ্রহ থেকে নেওয়া কৌতুকটা এ রকম। এক লোক বৃদ্ধ বয়সে ছেলেকে ধরেছেন একজন সংস্কৃত শিক্ষক জোগাড় করে দেওয়ার জন্য।
ছেলে : কী করবেন এই বয়সে সংস্কৃত শিখে?
বাবা : মরার পর তো সেটাই কাজে লাগবে। সংস্কৃত হলো স্বর্গের ভাষা।
সামনে ছিল তার ১০ বছর বয়সের নাতি। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘দাদু, তুমি স্বর্গে যাবে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। নরকেও তো যেতে পারো। তখন?’
বাবা মানে ওর দাদু একটুও না ভেবে বললেন, ‘আমি অনেক দিন দিল্লি-উত্তর প্রদেশে কাটিয়েছি। হিন্দি ভাষাটাও জানি।’
মানে কী? হিন্দি নরকের ভাষা!
না, এটা স্রেফ রসিকতা। আসল কথাটা হলো, ভাষা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বম সম্পদ। ভাষা দূরের মানুষকে কাছে আনে। ঘনিষ্ঠদের আরো ঘনিষ্ঠভাবে মেলায়।
অথচ কী আশ্চর্য, আমরা ভাষা শিক্ষার অর্থটাই বদলে ফেলেছি। ইংরেজির ভূতুড়ে মানদণ্ডে তৈরি করছি এক বিভক্তির বিষরেখা। যেখানে ‘ইংরেজি জানলেই সব ভালো’। না জানলে ‘দূরে সরো।’
মোস্তফা মামুন : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক