ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিবন্ধন বিধিমালা কার্যকর হচ্ছে

বিভাষ বাড়ৈ |

দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে কার্যকর হতে যাচ্ছে বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত নতুন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিবন্ধন বিধিমালা। ‘ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিবন্ধন বিধিমালা-২০১৭’ অনুসারে দেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলকে সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আনার কাজ শুরু করেছে শিক্ষা বোর্ড এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)।

উচ্চ আদালতের আদেশ ও বিভিন্ন মহলের দাবি অনুসারে স্কুলের বেতন ফি নির্ধারণে আনা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ। এদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বিধিমালা কার্যকর হতে চললেও কিন্ডার গার্টেন স্কুল (কেজি) নীতিমালা কার্যকরের কোন উদ্যোগ নেই। ২০১১ সালে একটি নীতিমালা করে নিবন্ধনের নির্দেশ দেয়া হলেও মন্ত্রণালয়ের এখন পর্যন্ত তাতে সাড়া দিচ্ছে না কেউ।

ইংরেজি মাধ্যম বিধিমালা কার্যকরের বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেছেন, আমরা বিধিমালা কার্যকরের কাজ শুরু করেছি। সারাদেশে এ ধরনের স্কুলের তথ্য আমরা সংগ্রহ করছি। এখন থেকে সকল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলকে সরকারী নিবন্ধনের আওতায় আসা বাধ্যতামূলক।

এছাড়া চাইলেই কেউ ইচ্ছেমতো বেতন ফি বাড়াতে পারবে না। বাড়াতে হলে শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে আবেদন করে এডিসি‘র (শিক্ষা) অনুমোদন নিতে হবে। তারা অনুমোদন করলেই কেবল বেতন ফি বাড়ানো যাবে। আর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বলছে, যেসব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এখনও নিবন্ধিত হয়নি তাদের নতুন বিধিমালা অনুসারে অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রায় চার বছর ধরে আটকে ছিল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিধিমালা প্রণয়ন কাজ। নীতিমালা না থাকায় বছরের পর বছর ধরে ফ্রি স্টাইলে চলছে স্কুলগুলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলাদের গাফিলতির কারণে এতদিন এ স্কুলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না শিক্ষা বোর্ডগুলো।

জানা গেছে, চার বছর আগে একবার শিক্ষা বোর্ডগুলো অবৈধভাবে পরিচালিত হওয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল এসব স্কুলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা। দেশে পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের জন্য একটি পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে ২০১২ সালে উচ্চ আদালত নির্দেশনাও দিয়েছিল। সে অনুযায়ী ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমাও দিয়েছিল। এরপরও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের কর্মকর্তারা এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। এসব স্কুলের জন্য একটি পৃথক বিধিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে গত বছর উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল। তারপর শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বিশেষ উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে বিধিমালা। খসড়া প্রণয়নের পর মতামতও নেয়া হয় বিভিন্ন জনের। এক পর্যায়ে বিধিমালা চূড়ান্ত হয়।

গেল মাসে আদালতের আদেশ অনুসারেই বিধিমালা চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ইংরেজি মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও কিছু আমলার কারসাজিতে বিধিমালা কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন। অবশেষে প্রজ্ঞাপন অনুসারে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয় বার্তা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা গেছে বিধিমালা বাস্তবায়নকারী মূল সংস্থা শিক্ষা বোর্ডের কাছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মঈনুল হোসেন বলছিলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। এখন সকলকে নিবন্ধন করতেই হবে। সকল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। যারা ২০০৭ সালের বিধিমালা অনুসারে নিবন্ধন করেনি তাদের নতুন বিধিমালা অনুসারে নিবন্ধিত হতে হবে। নতুন বিধিমালায় সরকারী তদারকি বাড়ানো হয়েছে জনিয়ে তিনি বলেন, আমরা সব সময় মনিটরিং করব। কিভাবে প্রতিষ্ঠান চলছে। তাদেরও নিয়মিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে দিতে হবে।

বর্তমানে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সাময়িক নিবন্ধনপ্রাপ্ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল একশরও কম। তবে শিক্ষা ২০১১ সালের তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বেনবেইস) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সারাদেশে তিন ক্যাটাগরিতে ১৫৯টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ও লেভেল ৬৪টি এবং এ লেভেল স্কুল ৫৪টি এবং জুনিয়র লেভেলের আন্তর্জাতিক মানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে ৪১টি।

এই মুহূর্তে কত সংখ্যায় এই প্রতিষ্ঠান আছে তা জানা নেই সরকার কিংবা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানেরও। বোর্ড বলছে, যদি কেউ সাময়িক নিবন্ধনের জন্য আসে তবে সেই প্রতিষ্ঠানেরই হিসাব থাকে তাদের কাছে। অন্যদের কোন হিসাব নেই বোর্ড, মন্ত্রণালয় কারও কাছেই। দু’একটি ছাড়া সাময়িক নিবন্ধনপ্রাপ্ত বাকি সব স্কুলই সাময়িক অনুমোদনের শর্ত যথাযথভাবে মানছে না। উন্নত শিক্ষা বিস্তারের নামে এসব প্রতিষ্ঠান বেপরোয়া শিক্ষা বাণিজ্যে লিপ্ত।

কী আছে নতুন বিধিমালায়?

ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পরিচালনা করতে হলে সরকারী অনুমোদন বাধ্যতামূলক। প্রাথমিকভাবেও সাময়িক নিবন্ধন ছাড়া এসব স্কুল পরিচালনা করা যাবে না। বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিটি স্কুল ১১ সদস্যের ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এই কমিটিই শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, সেশন চার্জ এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করবে। বছরে ১০ শতাংশের বেশি টিউশন ফি কোন অবস্থাতেই বাড়ানো যাবে না। এসব স্কুলে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও ২ শতাংশ প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী ভর্তি করাতে হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অথবা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয় ও স্বাধীনতা বিরোধী, উগ্রবাদকে উস্কানি দেয় এমন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করা যাবে না।

এমন নানা শর্তের কথা বলা হয়েছে বিধিমালায়। তবে সরকারের কাছ থেকে নিবন্ধন না নিয়ে স্কুল চালালে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা বিধিমালায় নেই। তা বিধিমালায় স্পষ্ট করে বলা হয়ানি। বিধিমালা অনুযায়ী, ম্যানেজিং কমিটির ১১ সদস্যের মধ্যে ৬ জন থাকবেন উদ্যোক্তা সদস্য, ২ জন শিক্ষক প্রতিনিধি এবং ২ জন অভিভাবক প্রতিনিধি। প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ পদাধিকার বলে কমিটির সদস্য সচিব থাকবেন। কমিটি বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ৬টি কাজ সম্পন্ন করবে। এগুলো হচ্ছে- টিউশন ফি নির্ধারণ, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন নির্ধারণ, স্কুলের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা, অবকাঠামো, শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করা অন্যতম। সংরক্ষিত ও সাধারণ- দুই নামে স্কুলের দুটি তহবিল থাকবে। সংরক্ষিত তহবিল সঞ্চয়পত্র আকারে বা তফসিলি ব্যাংকে আমানত রাখতে হবে। বিধিমালা বলা হয়েছে- প্লে-গ্রুপ, নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন বা প্রাথমিক স্কুলের জন্য মেট্রোপলিটনে ৩ লাখ, জেলা সদরে আড়াই লাখ, জেলা সদরের বাইরে ২ লাখ টাকা থাকতে হবে। অন্যদিকে নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও সমমানের স্কুলের সংরক্ষিত তহবিল মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য ৪ লাখ, জেলা সদরে ৩ লাখ, জেলার বাইরে ২ লাখ টাকা থাকতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই তহবিল মেট্রোপলিটনে ৫ লাখ, জেলা সদরে ৪ লাখ, জেলার বাইরে ৩ লাখ টাকা হবে। নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন ছাড়া এই অর্থ কোনভাবেই তোলা বা ভাঙ্গানো যাবে না। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে সরকারী বিধি অনুসরণ করতে হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056860446929932