ইংরেজির ম্যাজিকে এবার ভালো ফল

নিজস্ব প্রতিবেদক |

গত বছরের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে খারাপ করেছিল শিক্ষার্থীরা। এতে করে পাসের হার ছিল ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু এ বছর ইংরেজি ভীতি কাটিয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে ভালো করায় বেড়েছে পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা। এ ছাড়া আগের মতোই ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে মেয়েরা। পাঁচ বছর ধরেই মেয়েরা ধারাবাহিকভাবে ভালো ফল করে আসছে।

এবার আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডসহ ১০ বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। গড় পাসের হার ৭৩.৯৩ শতাংশ। গত বছর ছিল ৬৬.৬৪ শতাংশ। এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪৭ হাজার ২৮৬ জন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার ২৬২ জন। এ ছাড়া এবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯০৯টি, যা গত বছরের তুলনায় ৫০৯টি বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৪টি কমে দাঁড়িয়েছে ৪১টিতে।

গতকাল বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়। সকাল ১০টায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সব বোর্ড চেয়ারম্যান ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফলের অনুলিপি তুলে দেন। এরপর দুপুর ১টায় সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ফলের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। তারপর থেকেই শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ফল জানতে শুরু করে।

বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে এবারের ভালো ফলের পেছনে আরো কয়েকটি কারণ জানা গেছে। এর মধ্যে আছে পাঁচ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার বেশি বৃদ্ধি। এ ছাড়া নতুন পদ্ধতিতে খাতা দেখার যে ভীতি ছিল তা কাটিয়ে উঠেছেন শিক্ষকরা। আর বোর্ডভিত্তিক আলাদা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার প্রভাবও পড়েছে মূল্যায়নে।

ভালো ফলের কারণ তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘উত্তরপত্র মূল্যায়ন, অবমূল্যায়ন ও অতিমূল্যায়ন রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। শিক্ষক প্রশিক্ষণে আমরা জোর দিয়েছি। এ ছাড়া আগে থেকেই পরীক্ষা গ্রহণে বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি আমরা। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। সব মিলিয়ে ফল ভালো হয়েছে। তবে আমরা চাই, সবাই পাস করুক। আগামীতে সবাই যেন আরো ভালো প্রস্তুতি নেয়। শিক্ষক ও অভিভাবকরাও যেন আরো মনোযোগী হয়।’

ফল বিশ্লেষণে জানা যায়, মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে বেশি খারাপ করে। এবার এ বিষয়েই ভালো ফল করায় গত বছরের তুলনায় মানবিকে গড় পাসের হার প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে গড় পাসের হারে। এবার ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৭৬.৩৪ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭৫.৪৮ শতাংশ। রাজশাহী বোর্ডে ৯৬.৮৬ শতাংশ, গত বছর ছিল ৭২.৬৭ শতাংশ। কুমিল্লায় ৯৬.৪৬ শতাংশ, গত বছর ছিল ৭৩.৩৫ শতাংশ। যশোরে ৯৫.২২ শতাংশ, গত বছর ছিল ৬৫ শতাংশ। চট্টগ্রামে ৯৩.০৯ শতাংশ, গত বছর ছিল ৭৩.৭৪ শতাংশ। বরিশালে ৯১.৬১ শতাংশ, গত বছর ছিল ৭১.০৬ শতাংশ। সিলেটে ৯২.৪৮ শতাংশ, গত বছর ছিল ৮২.৩৩ শতাংশ। দিনাজপুরে ৯৫.১৩ শতাংশ, গত বছর ছিল ৬৫.৫১ শতাংশ।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘ইংরেজি ও আইসিটিতে পাসের হার বাড়ায় গড় পাসের হার বেড়েছে। গত বছর এই দুটি বিষয়ে খারাপ হওয়ার পর আমরা বিশেষ নজর দিয়েছিলাম। ফলে এবার শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে।’

ছেলেদের তুলনায় পাঁচ বছর ধরেই মেয়েরা ভালো করছে। এবার ছেলেদের পাসের হার ৭১.৬৭ শতাংশ আর মেয়েদের ৭৬.৪৪ শতাংশ। তবে জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে এগিয়ে আছে ছেলেরা। ২৪ হাজার ৫৭৬ জন ছেলে জিপিএ ৫ পেয়েছে। মেয়েদের জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ২২ হাজার ৭১০।

এ বছর মোট পরীক্ষার্থীর অর্ধেকই ছিল মানবিক বিভাগের। এ বিভাগে গড় পাসের হার ৬৫.০৯ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৫৬.৪৬ শতাংশ। তবে বিজ্ঞানে পাসের হার সবচেয়ে বেশি ৮৫.৫৭ শতাংশ। ব্যবসায় শিক্ষায় পাসের হার ৭১.৮৫ শতাংশ।

এ বছর পাসের হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে যশোর বোর্ডে। গত বছর যশোর বোর্ডে পাসের হার ছিল ৬০.৪০ শতাংশ, এবার প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫.৬৫ শতাংশ। এর পরেই আছে কুমিল্লা বোর্ড। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে এ বোর্ডে পাসের হার ছিল ৪৯.৫২ শতাংশ। আর গত বছর ছিল ৬৫.৪২ শতাংশ। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭.৭৪ শতাংশ। মাদরাসা বোর্ডে গত বছর পাসের হার ছিল ৭৮.৬৭ শতাংশ, এবার ৮৮.৫৬ শতাংশ। রাজশাহী বোর্ডে গত বছর পাসের হার ছিল ৬৬.৫১ শতাংশ, এবার ৭৬.৩৮ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডে গত বছর পাসের হার ছিল ৬০.২১ শতাংশ, এবার ৭১.৭১ শতাংশ।

কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবদুস ছালাম বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা আগে যে বিষয়গুলোতে খারাপ করত সেগুলোতে আমরা খুব জোর দিয়েছি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, কর্মশালার আয়োজন করেছি। শিক্ষকদেরও ইংরেজি বিষয়ে বেশি জোর দিতে বলেছি। এতে ভালো ফল হয়েছে।’

এ ছাড়া অন্য পাঁচ বোর্ডে পাসের হার গত বছরের তুলনায় বাড়লেও তা স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। চট্টগ্রাম বোর্ডে এবার পাসের হার সবচেয়ে কম—৬২.১৯ শতাংশ। ঢাকা বোর্ডে এবার পাসের হার ৭১.০৯ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৭০.৬৫ শতাংশ, সিলেট বোর্ডে ৬৭.০৫ শতাংশ ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৮২.৬২ শতাংশ। ঢাকা বোর্ডের পাসের হার গড় হারের চেয়ে কম হলেও জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। এই বোর্ড থেকে ১৮ হাজার ১৮৭ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজশাহী বোর্ডে ছয় হাজার ২৭৯ ও তৃতীয় সর্বোচ্চ যশোর বোর্ডে পাঁচ হাজার ৩১২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে।

পাঁচ বোর্ডে পাসের হার বেশি বৃদ্ধির পেছনে কেউ কেউ বোর্ডভিত্তিক প্রশ্নপত্রের কথাও বলেছেন। কোনো বোর্ডে সহজ বা কোনো বোর্ডে কঠিন প্রশ্ন হয়েছে বলে মত দেন কেউ কেউ। তবে এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আসলে শিক্ষার্থীদের ভালো ও খারাপ ফলের তারতম্যই বোর্ডের গড় পাসের হারে প্রতিফলিত হয়েছে। যে বোর্ডে বেশি পাস করেছে সেখানে প্রশ্ন সহজ আর যেখানে কম পাস করেছে সেখানে প্রশ্ন কঠিন হয়েছে, তা ঠিক নয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর ধরে নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন পরীক্ষকরা। এতে যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে। এবার পরীক্ষকদের একটি মডেল উত্তরপত্র দেওয়া হয়। কম লিখে কেউ যাতে বেশি নম্বর না পায় আবার ভালো লিখে কেউ যাতে বঞ্চিত না হয়, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রধান পরীক্ষকরা ১২ শতাংশ খাতা পুনর্মূল্যায়ন করেন। তবে গত দুই বছর নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ভীতি ছিল শিক্ষকদের। গত বছর ফল খারাপ হওয়ার পেছনে খাতা মূল্যায়নও অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তারা। তবে তাঁরা মনে করছেন, সেই ভীতি দূর হয়েছে। নতুন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন শিক্ষকরা।

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে খাতা দেখার পরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন আসে। এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘কোনোভাবেই খাতা দেখার ভুল গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা চাই ভুলগুলো যেন একবারেই না হয়। এ জন্য পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষক খাতা দেখার পর প্রধান পরীক্ষক একটা নির্দিষ্ট অংশের খাতা দেখেন।’ তিনি বলেন, যেহেতু পরীক্ষার্থী অনেক তাই আইন পরিবর্তন করে খাতা পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030291080474854