ইউজিসি থেকে উচ্চশিক্ষা কমিশন

ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী |

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরিবর্তে বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন হতে যাচ্ছে। কয়েক বছরব্যাপী অব্যাহত প্রয়াসের ফল হিসেবে এই কমিশন গঠিত হতে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এ দেশে আমিই প্রথম একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের প্রস্তাব রেখেছিলাম। প্রস্তাবটি রেখেছিলাম একটি পত্রিকায় কলাম লেখার মাধ্যমে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ড. এম হেলাল আমার ওই লেখাটি দু’দুবার ছেপেছেন। এমনকি একটি সাক্ষাৎকারেও আমি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ করি। এসব প্রস্তাব সরকার বা ইউজিসির পক্ষ থেকে বহুবার উচ্চারিত হয়ে এখন কার্যে রূপান্তর হচ্ছে দেখে আমরা আনন্দিত। এই আইনটি পাস হলে অতীতের ভূমিকা থেকে মঞ্জুরি কমিশন সরে আসবে এবং বর্তমানে সরকারি খাতে ৪৪টি ও বেসরকারি খাতের ১১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভাল করার দায়িত্ব কমিশন নিতে পারবে। দায়িত্বের সঙ্গে কর্তৃত্বের একটা সম্পর্ক আছে, আর আছে কর্তৃত্বের সঙ্গে ক্ষমতার একটি সমতার বা সামঞ্জস্যতার সম্পর্ক। আশা করা যাচ্ছে, আইনটি পাস হলে শুধু ইউজিসিই বিলুপ্ত হবে না, একটি যোগ্য সংগঠনের হাতে উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করা হবে।

আমি এ কারণে উচ্চশিক্ষা কমিশনের ব্যাপারে আন্তরিক; আর একটি কারণে এই নাম পরিবর্তনে আমি আগ্রহী। পৃথিবীর মাত্র অল্প কিছু দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন রয়েছে। পাকিস্তান অবশ্য নামটি পরিবর্তন করে কোনো উন্নতির পথনির্দেশনা দিতে পারেনি; বরং উচ্চশিক্ষাকে এতিম করে ফেলেছে। এই একটি কারণে আমি উচ্চশিক্ষা কমিশনের পাশাপাশি একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল কামনা করছিলাম। ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের বিধান ছিল বলেই সরকার উদ্যোগী হয়ে একটি আইন প্রণয়ন করেছে এবং এরই মধ্যে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও নিয়োগ দিয়েছে। আমার মতে, ২০১০ সালের আইনের প্রতি যথাযথ সম্মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল করে দিলে ইউজিসি অনেক সংকট ও মাথাব্যথামুক্ত হতো এবং শিক্ষাবাণিজ্য রহিত হতো।

এখন উচ্চশিক্ষা কমিশন ও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল সম্পূরক ও পরিপূরক সংস্থা হিসেবে উন্নয়নশীল দেশের উপযোগী মানসম্পন্ন ও বিশ্বজনীন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে। তবে দুটি প্রতিষ্ঠান যদি সাংঘর্ষিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে আমাদের আশায় গুড়ে বালি পড়বে। তাই আইনটি পাসের আগে মন্ত্রিসভায় ও সংসদে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই চূড়ান্ত রায় দেয়া বাঞ্ছনীয়। ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি প্রণয়নের আগে ও পরে সংশোধন প্রয়াসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সহায়তা নিয়ে সরকার বুদ্ধিসত্তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। এমনকি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলটি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণয়ন না করে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই করা হয়েছে। আরও একধাপ এগিয়ে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্বের বিধান এ আইনে সন্নিবেশিত করেছে। এখন উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন হতে যাচ্ছে; কিন্তু তার গঠন প্রক্রিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল কি না, আমার জানা নেই। তবে উচ্চশিক্ষা কমিশনটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ উভয়বিধ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গঠিত হতে যাচ্ছে। এ দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলো তাদের প্রদত্ত প্রতিশ্র“তির সার্থক বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কৃত্রিম ও অযৌক্তিক সীমারেখা মুছে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে দু-একটি কথা বলার চেষ্টা করছি।

প্রস্তাবিত কমিশনটি আইনের সুদৃষ্টি পেলে একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবে। প্রস্তাবিত আইনে কমিশনে একজন চেয়ারম্যান থাকবেন যাকে অপসারণ শুধু হাইকোর্টের বিচারকদের অপসারণের প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে করা যাবে। কমিশনে একজন চেয়ারম্যান ছাড়াও ৫ জন পূর্ণকালীন সদস্য, ৩ জন খণ্ডকালীন সদস্য থাকবেন। খণ্ডকালীন সদস্যরা হবেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিভাগের সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য ও অর্থ বিভাগের সচিব তারা সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুক্রমের ভিত্তিতে মনোনীত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তিনজন ভিসি, একই প্রক্রিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনজন ভিসি এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুক্রমের ভিত্তিতে মনোনীত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ডিন এ কমিশনে থাকবেন। এ ব্যাপারে আপত্তির কারণ নেই, তবে এক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্যটা পাকিস্তান আমলের পূর্ব-পশ্চিমের সংখ্যা সাম্যের মতো শুনাচ্ছে। পাকিস্তান আমলে বাঙালির সংখ্যা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ হলেও কূটচালে ৫০ ভাগ মেনে নিতে হয়েছিল তার পরিণতি সবার জানা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বিবেচনা রাখলে তাদের প্রায় ৭০ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। শুনেছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি এমন দাবি না করলেও কমপক্ষে সম-সংখ্যক ডিন দাবি করছে। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের মতো উচ্চ শিক্ষা কমিশনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের যুক্তিসঙ্গত প্রতিনিধিত্বের দাবি রাখে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি আরও কিছু ব্যাপারে তাদের দাবি উত্থাপন করবে বলে শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ পূর্ণকালীন সদস্যদের শিক্ষাগত ও অন্যান্য যোগ্যতা নিয়ে কোনো আপত্তি না করলেও চেয়ারম্যানের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রস্তাবনায় আছে যে, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিমান ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব যিনি শিক্ষক বা প্রশাসক হিসেবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাৎপর্য অবদান রাখিয়াছেন, এমন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি উচ্চশিক্ষা কমিশনে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের যোগ্য বলিয়া বিবেচ্য হইবেন। চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা, বেতন-ভাতাদি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত হইবে।’ পূর্ণকালীন সদস্যদের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ যাহার শিক্ষকতা ও গবেষণা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে অন্যূন ২০ বছরের অভিজ্ঞতা রহিয়াছে, এমন ব্যক্তি কমিশনের পূর্ণকালীন সদস্য হইবার জন্য যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবেন। কমিশনের সদস্যদের পদমর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত হইবে।’ এ দুটি বিধানকে একত্রে দেখলে দেখা যায়, সদস্যদের যোগ্যতা বরং চেয়ারম্যানের চেয়ে সুস্পষ্ট ও কঠোর। এটা বাঞ্ছনীয় এবং বিশাল সংখ্যক উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের পরামর্শ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং শিক্ষকতা, গবেষণা ও প্রশাসনে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিই প্রয়োজন যাতে ধার ও ভারের সম্মিলন ঘটবে, আইনগত কর্তৃত্ব ও অর্জিত কর্তৃত্বের সমাহার ঘটবে এবং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সমপর্যায়ে পৌঁছবে। খণ্ডকালীন সদস্যদের মধ্যে ভিসি ও ডিনরা অনুক্রমের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োজিত হবেন। এ অনুক্রম শব্দটি যথেষ্ট ঘোরপ্যাঁচের জন্ম দিতে পারে বলে তা বর্জন আবশ্যক। এখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সংশোধনও বাঞ্ছিত নয় বরং এসব খণ্ডকালীন সদস্য নিয়োগে রাষ্ট্রপতির পূর্ণ কর্তৃত্ব বহাল রাখতে হবে।

কমিশনের একটি সচিবালয় থাকবে এবং কমিশনের সচিব সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এই ধারাবলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্য আমলাতন্ত্রের আবির্ভাব হবে বলে অনেকে মনে করেন। তবে কমিশন যদি উপদেষ্টা বা পরামর্শকের ভূমিকা ছাড়া নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়, তাহলে এ ধারায় কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে কমিশন ও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের ভূমিকার সুস্পষ্টীকরণ প্রয়োজন। পৃথিবীর অনেক দেশেই মঞ্জুরি কমিশনের জায়গায় উচ্চশিক্ষা কমিশন রয়েছে, আবার অনেক দেশেই শুধু অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল থাকলেও যুগপৎ উচ্চশিক্ষা কমিশন নেই। এক্ষেত্রে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেয় কি না, বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন পাস করার আগে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। প্রয়োজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। কমিশনের কার্যাবলি বলতে কতিপয় পরামর্শক, প্রণোদনামূলক ও কতিপয় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রয়েছে।

এ আইন কার্যকর হলে অন্তত একটি ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য রয়ে যাবে। সেটি হল কোর্স অনুমোদন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ কোর্স অনুমোদন করলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এসব কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি সত্ত্বেও কোর্স অনুমোদনের জন্য কমিশনের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হবে। একই যাত্রায় দু’ফল কি একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য? আমার মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও উচ্চশিক্ষা কমিশন আইনটি একই সঙ্গে প্রণয়ন আবশ্যক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমনটা মতামতের সুযোগ ছিল বা আছে, উচ্চশিক্ষা কমিশনের ক্ষেত্রে তেমনি তাদের যথোপয্ক্তু ভূমিকা থাকা প্রয়োজন।

 

লেখক : বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভিসি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

 

সৌজন্যে: যুগান্তর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032279491424561