বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. আখতার হোসেনের পদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি ইউজিসি সদস্যের পদে থেকেও গত বছর ২৮ জুন নিজ কর্মস্থল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) যোগ দেন। অবসর সুবিধা নেয়ার জন্য তিনি সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। অবসর নেয়ার পর আবার তিনি ফিরে এসে ইউজিসির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর পুরো বিষয়টি তিনি ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাছে গোপন করেছেন। সোমবার (৭ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউজিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তার এই যোগদানের মাধ্যমে আইন দু'ভাবে লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত, তিনি প্রেষণে তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউজিসিতে এসে যোগদান করেন। প্রেষণ পদ থেকে অব্যাহতি না নিয়ে মূল পদে ফেরত যাওয়ার সুযোগ নেই। আবার মূল পদে যোগদান করার পর নিজের ইচ্ছামতো প্রেষণ পদে ফিরে আসারও উপায় নেই। তারা বলেন, দ্বিতীয় ব্যত্যয় হলো, ইউজিসির সদস্যপদে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দুই বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। আগামী জানুয়ারিতে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। ইউজিসি আইন অনুসারে, কেবল চেয়ারম্যানরাই দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পেতে পারেন; সদস্যরা নন।
এই সদস্যপদের বৈধতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, 'বিষয়টি আসলে অতটা ভালো জানি না। আগে বিস্তারিত জানতে হবে। আপনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞেস করলে সবচেয়ে ভালো হয়।'
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সোহরাব হোসাইনকে ফোন করা হলে তিনি কল ধরেননি।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, অধ্যাপক আখতার হোসেন ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেষণে চার বছরের জন্য ইউজিসির সদস্যপদে নিয়োগের আদেশ পান। সদস্যপদে যোগদান করেন ১৪ জানুয়ারি। সে হিসাবে তার মেয়াদকাল ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি। নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী, তিনি চার বছর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্ব শেষে নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাবেন। সদস্য হিসেবে যোগদানের পর নির্দিষ্ট মেয়াদে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে পারবেন না। মূল কর্মস্থলে যোগদান করতে হলে তাকে সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি নিতে হবে। কিন্তু অব্যাহিত না নিয়েই এই সদস্য গত বছরের ২৮ জুন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মূল পদে যোগদান করেছেন। আবার ইউজিসির সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।
মূল পদে যোগদানের পর ইউজিসিতে তার দায়িত্ব পালন ও নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির কয়েক কর্মকর্তা। তাদের অভিযোগ, বেতন-ভাতা, বাসা ভাড়া, বাসার কুকের বেতন-ভাতাসহ তার পেছনে সরকারের প্রতি মাসে তিন লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়। সে হিসাবে গত ১৫ মাসে তার পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
বাকৃবি সূত্রে জানা যায়, অধ্যাপক আখতার হোসেন নিয়োগের শর্ত ভঙ্গ করে গত বছরের ২৮ জুন নিজ কর্মস্থলে যোগদান করেন। অবসর প্রস্তুতির জন্য মূল কর্মস্থল ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে তিনি যোগদান করেন ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়কে না জানিয়েই। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, মূল কর্মস্থলে যোগদানের ফলে তার নিয়োগের আর বৈধতা নেই। ১৫ মাস ধরে সদস্য হিসেবে তিনি সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন অবৈধভাবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, কাউকে না জানিয়ে তার এভাবে যোগদান করতে যাওয়া আইনানুগ হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত কিছু বিধিবিধান রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়, চার বছরের জন্য নিয়োগে রয়েছেন, কিন্তু তার অবসরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে- এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে মূল পদে যোগদান করে আবার ফিরে এসে যোগদান করতে হয়। অথচ আখতার হোসেন অনুমতি না নিয়ে ইউজিসির সদস্যপদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
অবশ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটা অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, রাষ্ট্রপতি তাকে চার বছরের জন্য কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এটি শেষ নিয়োগ। কিন্তু ৩০ বছর চাকরি করেছেন, পেনশন তো তাকে নিতে হবে। সেখানে যোগদান না করলে পেনশন পাবেন না। এটা অপরিহার্য হয়ে যায়।
এসব বিষয়ে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন বলেছেন, অবসর নিতে হলে যোগদান করতে হবে মূল পদে, এটাই নিয়ম। তিনিও তা করেছেন। এটা রুটিন কাজ। রাষ্ট্রপতির আদেশে সদস্য হিসেবে চার বছরের জন্য তার নিয়োগ, সেটা কোনোভাবেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হতে পারে না। তিনি বলেন, অসাবধানতাবশত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়া হয়নি। এটা হলে ভালো হতো। এটা ব্যক্তি পর্যায়ে তার একটি ভুল। অন্যদিকে, বাকৃবি থেকে তিনি প্রেষণে এসেছেন। তারাও তাকে এই অনুমতি নেওয়ার কথা বলেনি। সেটিও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভুল। এই ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ভুলের বিষয়টি কোনো দুরভিসন্ধিমূলক নয়। কারণ, এর পেছনে কোনো লাভালাভের বিষয়ও নেই। অধ্যাপক আখতার বলেন, এখনও এ বিষয়টিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভূতাপেক্ষ অনুমতি দেয়ার সুযোগ রয়েছে।