ইতিহাসের অগ্রগতির কাহিনী বর্তমানের ভেতরেই : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

টুকরো টুকরো খবর মিলে যে নির্মম বাস্তবতা কখনও কখনও ফুটে ওঠে তা ঢেকে রাখা যায় কি? চেষ্টা হচ্ছে এবং হয়ও কিন্তু পারা যাচ্ছে না কিংবা যায় না। সরকারের দায়িত্বশীলরা উন্নতির আড়ম্বরপূর্ণ কথা শোনান বটে কিন্তু বাস্তব সত্যটা টুকরো টুকরো ছোট ছোট খবরেই বের হয়ে আসে কিংবা আসছে। খবরের কাগজ অপরাধের খবর নিয়ে লোফালুফি করছে। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখলে মনে হবে স্বর্গের সমুদয় সুখ টোকা দিচ্ছে দর্শকদের জানালায়। কিন্তু এসব দেখে শেষ পর্যন্ত অনেকেই বিরক্তই হন। কোনো কোনো পত্রিকায় বিনোদন সংবাদের নামে কোনো কোনো নায়িকার গায়ের কাপড় সংক্ষিপ্তকরণের যে চিত্র প্রদর্শনী ছাপানো হয়, সেসব ছবিতে তাদের বস্ত্র ধরে টানাটানি হচ্ছে, তাদের মুখের হাসির নিচে দেখা যায় শান্ত এক বিষণ্ণতা। ওই বিষণ্ণতাটা কিন্তু এখন সর্বজনীন। রোববার (১৭ মে) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, বিষণ্ণতা তো বললাম, কিন্তু তাই বলে প্রতিক্রিয়া কি নেই? আছে। প্রতিক্রিয়া আছে। দু'ধরনের সেটা। এক ধরনের প্রতিক্রিয়ার দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে ঢাকার একটি ঘটনাতে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিল কাছেরই এলাকা লক্ষ্মীবাজার দিয়ে। ঘটনাটি দূর অতীতের নয়। তাকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করে দুই যুবক। যুবক দুটি মোটরসাইকেল চেপে এসে হামলা শেষে মোটরসাইকেল চেপে দিব্যি চলে গেছে। যেন ছিনতাইকারী। রাস্তায় লোক ছিল। না, কেউ এগিয়ে আসেনি। ঠিক এর বিপরীত ঘটনা ঘটেছে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার এক গ্রামে। সেখানে খালের ওপর ব্রিজ তৈরি করা নিয়ে ঠিকাদারদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের ঝগড়া বাধে। ঠিকাদার কাজ থামিয়ে দেয়। খবর পেয়ে ছাত্রলীগের এক নেতার নেতৃত্বে জন পনেরোর একটি বাহিনী চলে আসে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে। স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। একটি ঘটনা উদাসীনতার অন্যটি হিংস্রতার। দুটোই ঘটেছে বলতে গেলে চরম অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে। প্রতিক্রিয়া হওয়ার প্রয়োজন ছিল সুসংগঠিত এবং বিদ্যমান অবস্থাকে বদলাবার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। ইতিহাস লিখতে হয় না, আপনা আপনিই তৈরি হয়ে যায়। যেন আছড়ে পড়ে। কিন্তু ইতিহাস কোনদিকে যাবে?

যাই বলি না কেন ইতিহাস তো কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। ইতিহাস মানুষই তৈরি করে। যদিও ইতিহাস তৈরি করতে হয় ইতিহাসের ভেতরে থেকেই। আসলে সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসটাই এখন একটা ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে, যেখানে তাকে মোড় ঘুরতে হবে। হাজার বছর ধরে সম্পদের যে মালিকানা ব্যবস্থা চালু আছে, তাকে এখন মোড় বদলে সামাজিক মালিকানার দিকে যেতে হবে। শতকরা নব্বইজন মানুষ মেহনত করবে, শ্রম ও সময় দিয়ে চালু রাখবে উৎপাদনের ব্যবস্থাকে, আর তার মালিকানা থাকবে শতকরা দশজনের হাতে। এই অন্যায় ব্যবস্থা সম্ভবত আর বেশিদিন চলবে না। বস্তুত এই ব্যবস্থাটা চালু আছে বলেই তো বিশ্বজুড়ে আজ এত অশান্তি। বস্তুগতভাবে বিশ্ব এখন উন্নতির চরম শীর্ষে সমুপস্থিত। এক করোনাভাইরাস পৃথিবীকে আজ যেভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছে, বিশ্বময় মানুষের পরস্পর বিচ্ছিন্নতাকে সাময়িকভাবে যে রকমের চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছে, তাতে বোঝা যায় ভেতরে ভেতরে এবং মানুষের জন্য ব্যবস্থাটা এখন কতটা ভঙ্গুর ও বিপজ্জনক। এর শেষ কোথায়- এ প্রশ্নটা অনেকেই তুলছেন কিন্তু উত্তরটা জানা নেই অনেকেরই।

পৃথিবীটা নিশ্চয়ই ভাঙবে না। কারণ মানুষ তাকে ভাঙতে দেবে না। কিন্তু না ভাঙার জন্য অত্যাবশ্যকীয় যে মোড় বদল সেটা সম্ভব করার ব্যাপারে নেতৃত্ব দেবে কারা? দেবে তারাই যারা বিপদটা বুঝবে বং বুঝবে যে, এই বিপদ থেকে মুক্তির পথ পুঁজিবাদের ভেতরে আটকে থাকা নয়, উল্টো সেই বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে যাওয়া, পথ ধরা সমাজতন্ত্রের। এক কথা, নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সমাজতন্ত্রীদেরই। কাজটি অবশ্যই কঠিন, অত্যন্ত কঠিন। কারণ এ হচ্ছে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা ও প্রায় স্থায়ী হয়ে যাওয়া একটি বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন। পরিবর্তনের বস্তুগত শর্তগুলোর পূরণ ঘটছে। আমরা দেশের ভেতরে যেসব সামাজিক ঘটনাগুলোর দিকে তাকাই এবং বিশ্বজুড়ে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধির যে খবরে উদ্বেগান্বিত থাকি, সেগুলো সবই কিন্তু অজান্তে পরিবর্তনের শর্ত পূরণের কথাটাই জানিয়ে দেয়। এমন অবস্থা তো চলতে পারে না। কিন্তু আত্মগত প্রস্তুতি তো আবশ্যক। আত্মগত প্রস্তুতিটা কেবল এক দেশে নয়, চাই সমগ্র বিশ্বজুড়ে।

সে প্রস্তুতি চলছেও বটে। খোদ আমেরিকার বার্নি স্যান্ডার্স নামে একজন নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলে প্রকাশ্যে ও সগর্বে ঘোষণা দিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন প্রার্থী হয়েছেন। আগেরবার চেয়েছিলেন কিন্তু পার্টির মনোনয়ন পাননি। এবার মনোনয়ন পাবেন বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো পাবেন না। কারণ তার মনোনয়ন প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখে পুঁজিবাদী মহলে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। রিপাবলিকানরা তো অবশ্যই ডেমোক্রেটিকদের মধ্যেও গেল গেল রব। কায়েমি স্বার্থের সব মহল তার বিরুদ্ধে এক হয়ে রায় দিচ্ছে। তিনি যদি দলটির মনোনয়ন পানও তবু প্রেসিডেন্ট পদ পাবেন বলে ভরসা করা কঠিন। আর ঘটনাক্রমে তিনি যদি প্রেসিডেন্টের পদ পেয়েও যান, তাহলেও তো মৌলিক পরিবর্তন আনা তার পক্ষে অসম্ভবই রয়ে যাবে। তখন পরিস্কার বোঝা যাবে যে, নির্বাচনের পথে কাজ হবে না। প্রয়োজন হবে ধারাবাহিক এবং বিশ্বব্যাপী আন্দোলন। নির্বাচন হতে পারে আন্দোলনেরই একটি অংশ।

আন্দোলনের জন্য সচেতনতা ও সংগঠন চাই। আর সচেতনতা গড়ে উঠবে না এবং সংগঠন যদি বড়ও হয় তবুও টিকবে না, যদি না সমাজ-পরিবর্তনের অতিদৃঢ় অঙ্গীকার সৃষ্টি হয় জ্ঞানের অবিরাম সংগ্রহের ভেতর দিয়ে। জ্ঞান কেবল গ্রন্থ থেকে আসবে না; আসবে জীবনের বাস্তবতা ও ইতিহাসের সঠিক পাঠ থেকে। বলাই বাহুল্য, ইতিহাসের সঠিক পাঠটা মোটেও জাতীয়তাবাদী হবে না, হবে সমাজতান্ত্রিক। ইতিহাসের গতিপথ বদলাবার আন্দোলনটাই যা ভরসা, নইলে হতাশ হওয়ার একশ' একটা কারণ রয়েছে। আর বিদ্যমান ব্যবস্থাটা চায় ওই হতাশা বৃদ্ধি পাক। চায় মানুষ বিভ্রান্ত হোক। বাড়ূক মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা। ইতিহাসের অগ্রগতিকে অবরুদ্ধকারী দুর্বৃত্তরা মুক্তিপণ দাবি করছে। মুক্তিপণটা অন্যকিছু নয়, সেটি হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। ইতিহাসের অগ্রগতির কাহিনীটাও বর্তমানেরই এবং বর্তমানের ভেতরেই লিখিত হচ্ছে অবিরত।

 লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030949115753174