মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের আহবান জানিয়েছেন সমন্বতিভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য। সমন্বিত পরীক্ষা কেন প্রয়োজন- ভুক্তভোগী অভিভাবক ও শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কেউ এ যন্ত্রণা বুঝবেন না। দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় গড়ে ২/৩টি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন নামে ইউনিট করছে। ইংরেজি আদ্যাক্ষর ‘এ’ দিয়ে শুরু হয়ে প্রায় শেষ বর্ণ পর্যন্ত ইউনিটের নাম আছে। যত ইউনিট, তত টাকা আর তত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির লাভ- বিপরীতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের তত বিড়ম্বনা। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের বদনাম হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিটের জন্য আলাদা ভর্তি ফি ও পরীক্ষার তারিখ ভিন্ন থাকে। একইদিনে আবার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা থাকে। ভর্তি নিয়ে থাকে কোচিং প্রতিষ্ঠানের রমরমা বাণিজ্য। পরীক্ষাকালীন মাসব্যাপী ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি-ভোগান্তি চরমে উঠে। ভর্তি পরীক্ষার সময় হোস্টেল-ছাত্রাবাস কোথাও থাকার জায়গা থাকে না। যেসব অভিভাবকের মেয়ে শিক্ষার্থী থাকে, তাদের এ যন্ত্রণার শেষ থাকে না। সব অভিভাবক ভালো প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে চায়। কোথাও কোনো নিশ্চয়তা থাকে না ভর্তি হওয়ার। এ কারণে সবাইকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হয়।
অনেকদিন যাবত ভুক্তভোগীরা তাদের করুণ অভিজ্ঞতা দিয়ে বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে নিতে সামর্থ্য হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বিষয়টি সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেছেন, এজন্য তাকে অভিনন্দন জানাই। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। শিগগিরই ফলাফল প্রকাশিত হবে। উপযুক্ত সময়েই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান উপাচার্যদের নিয়ে কাজ শুরু করেছেন, যা খুবই আশাপ্রদ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বর্তমানে সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি কলেজসহ মোট ৬টি, টেক্সটাইল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসহ ১৪টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৯টি এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৩টি। কৃষিবিষয়ক প্রায় ১১টি বিষয় রয়েছে, যা কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ৫টি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৪টি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৪টি বিষয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। আবার সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, বাণিজ্য, কলা ও সামাজিক বিষয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো হচ্ছে। ভোগান্তি লাঘবের জন্য সমন্বিত পরীক্ষা বা গুচ্ছ পরীক্ষা শুধুমাত্র কৃষি, প্রকৌশল, প্রযুক্তি ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক পৃথকভাবে করলেও কাঙ্ক্ষিত সমাধান হবে না। প্রকৃত সমাধানের জন্য বিষয়ভিত্তিক সমন্বিত বা গুচ্ছ পরীক্ষা নেয়া প্রয়োজন।
বিষয়ভিত্তিক সমন্বিত বা গুচ্ছ পরীক্ষার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ নিুলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারেন-
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমন্বয়ে কৃষিবিষয়ক, প্রকৌশল (টেক্সটাইল ও লেদারসহ) বিষষক, বিজ্ঞানবিষয়ক, বাণিজ্যবিষয়ক এবং বিষয় পরিবর্তন বিষয়ক ইউনিটে ভিন্ন ভিন্ন ৫টি কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটি করতে হবে।
২. বিষয় পরিবর্তন বিষয়ক ইউনিটে বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ও সামাজিক বিষয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিষয়ভিত্তিক বিভাগ/শাখা অনুযায়ী আসন সংরক্ষিত থাকবে (যা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক করা আছে)।
৩. প্রতিটি ভর্তি কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিষয় নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কোড, বিষয় কোড ও আসন চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবেন।
৪. এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার ১ মাসের মধ্যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বর্তমান পরীক্ষা যোগ্যতা, নম্বর বিভাজন ও মেধাক্রম তৈরির কৌশল নির্ধারণ করে জাতীয়ভাবে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন।
৫. একজন বিজ্ঞানের ছাত্র ৪টি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় (কৃষি, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও বিষয় পরিবর্তন ইউনিটে), একজন বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ২টি ইউনিটে (বাণিজ্য ও বিষয় পরিবর্তন বিষয়ক ইউনিট) এবং একজন মানবিকের ছাত্র ১টি ইউনিটে (বিষয় পরিবর্তন বিষয়ে) যোগ্যতা সাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে।
৬. প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র/ভর্তি কমিটি মনোনীত কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের ভর্তি ফরমের পছন্দ অনুযায়ী উল্লেখিত কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
৭. এইচএসসি পাসের পর একজন ছাত্র-ছাত্রী পরপর দু’বারের বেশি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে না।
৮. ভর্তি পরীক্ষায় পাসের জন্য ন্যূনতম পাস নম্বর নির্ধারণ করা থাকবে।
৯. মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে সমন্বয় করে এক সপ্তাহের মধ্যে কৃষিবিষয়ক, প্রকৌশল (টেক্সটাইল ও লেদারসহ) বিষষক, বিজ্ঞানবিষয়ক, বাণিজ্যবিষয়ক এবং বিষয় পরিবর্তন বিষয়ক ইউনিটে (সব সরকারি প্রফেশনাল প্রতিষ্ঠান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামিক/আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে) ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন করতে হবে।
১০. প্রথমে উল্লিখিত ৫টি ইউনিটের লিখিত ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছে, কত নম্বর কাটা গেছে, ভর্তি পরীক্ষার স্কোর ও সামগ্রিক স্কোর জানতে পারবে।
১১. ফলাফল নিয়ে সংশয়ের উদ্রেক হলে নির্ধারিত ফি দিয়ে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার বিষয় পুনঃমূল্যায়ন করতে পারবে।
১২. পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিটের পছন্দক্রম নির্ধারিত সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনলাইনে ভর্তির টাকা প্রদান করবে।
১৩. ভর্তির তারিখ ও সময়সীমা উল্লেখ করে ৫ ইউনিটের প্রথম মেধা তালিকা ও কোটাসহ অনলাইনে প্রকাশ করতে হবে।
১৪. শিক্ষার্থীরা মেধা তালিকা দেখে চূড়ান্তভাবে বিষয় নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।
১৫. আসন শূন্য সাপেক্ষে ৬ ইউনিটের পর্যায়ক্রমিক কোটাসহ মেধাতালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং একইভাবে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
১৬. মেডিক্যালসহ বিশ্ববিদ্যালগুলোর ৬ ইউনিটের ভর্তি প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামিক/আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রচলিত নিয়মে কলেজ বা মাদ্রাসাগুলোয় ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করবে।
১৭. এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ৪ মাসের মধ্যে সব সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট তারিখে নতুন ক্লাস শুরু করতে হবে।
১৮. প্রফেশনাল উচ্চশিক্ষার জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। তবে প্রফেশনাল শিক্ষার জন্য সরকার কোনো নীতি প্রণয়ন করলে তা সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই মানতে হবে।
আশা করি, উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এ বছর থেকেই মহামান্য রাষ্ট্রপতির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে বিষয়ভিত্তিক সমন্বিত বা গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি কার্যকর করা হবে।
লেখক: অভিভাবক, লাহিড়ীপাড়া সড়ক, গোয়ালচামট, শ্রীঅঙ্গন, ফরিদপুর
সৌজন্যে: যুগান্তর