উদ্ভট উটের পিঠে ছাত্র রাজনীতি

আলী ফজল মোহাম্মদ কাওছার |

স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের সবকটি আন্দোলনে যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের ছাত্র সমাজ সরাসরি অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের ছাত্র সমাজের অনেকে শাহাদাত্ বরণ করেন । স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে  এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য ।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমান ছাত্র সমাজ কিংবা ছাত্র রাজনীতি কোন পথে পরিচালিত হচ্ছে? খুন, রাহাজানি, টেন্ডারবাজিতে ছাত্র সমাজ জড়িয়ে পড়ছে। দলীয় কোন্দলের বলি হয়ে অনেকের জীবন চলে যাচ্ছে, যা পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনের  মাধ্যমে আমরা জানতে পারি।

যে ছাত্র সমাজ কিংবা ছাত্র রাজনীতির এত এত সোনালী অর্জন সেই ছাত্র রাজনীতির জৌলুস হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, অছাত্রদের হাতে নেতৃত্ব। আবার যারা অছাত্র তাদের মধ্যে আবার অনেকে এসএসসি পাস কেউ আবার এইচএসসি পাস । ছাত্র সংগঠনের গঠনতন্ত্রে লিখা আছে, ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত হবে সংগঠনটি। তাহলে কেন এই অছাত্রদের হাতে সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়?  যারা আবার কম শিক্ষিত (ছাত্রত্ব নেই)।  যারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে ছাত্র রাজনীতিকে করছে কলুষিত। এর বিপরীতে যদি প্রকৃত ছাত্রদের এবং মেধাবী ছাত্রদের হাতে নেতৃত্ব দেওয়া হয় তাহলে তাদের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কারণ, তারা লেখাপড়া কিংবা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণ করে। এর ফলে তারা অপকর্ম করার সময় কম পায়। উচ্চ পর্যায়ে লেখাপড়ার ফলে তারা নৈতিক শিক্ষা অর্জন করতে পারে।

 অনেক ছাত্র সংগঠনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা তাদের সংগঠন চালাচ্ছে  বিবাহিতদের দ্বারা। যারা তাদের পরিবার চালানোর জন্য বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। কারণ, তারা তাদের সংগঠন পরিচালিত করতে গিয়ে অন্য কোনো কাজ করতে পারে না।

এছাড়া অনেক ছাত্র নেতারা তাদের প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপ গড়ে তোলেন। তারা তাদের গ্রুপের প্রভাব দেখাতে গিয়ে বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে সমাজ কিংবা এলাকায় অশান্ত পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে।

বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে এক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আরেক ছাত্র সংগঠনের সংঘর্ষ কিংবা নিজ দলের বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এর ফলে লেখাপড়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। চাইলে তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারতেন।

অনেকে আবার দেখা যায়, এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার জন্য ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। যাদের উদ্দেশ্য থাকে সমাজে কিংবা এলাকায় প্রভাব বিস্তার করা। তাদের উদ্দেশ্য থাকে না সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কল্যাণ করা। এর ফলে ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে কলুষিত।

আমাদের পূর্বসূরীদের ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র, সমাজ এবং মানুষের কল্যাণ করা আর এখনকার ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের কল্যাণ, প্রতিপত্তি, টাকা পয়সা কিংবা প্রভাব বিস্তার করা। উপরিউক্ত কারণগুলোর জন্য অনেকে এখন ছাত্র রাজনীতির আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে যেখানে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে।  সেই জায়গায় এখন শতকরা ২০-৩০ ভাগ ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত।

৯০ এর দশক পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল। বেশির ভাগ ছাত্র নেতারা ত্যাগের রাজনীতি করতেন। ছাত্র নেতারা প্রকৃত ছাত্র ছিলেন। কর্মীদের মূল্যায়ন ছিল। এর ফলে কর্মীরা নেতাদের ত্যাগ দেখে  অনুপ্রাণিত হতেন। ২১ শতকে এসে ছাত্র রাজনীতি তার জৌলুস যেন হারিয়ে ফেলেছে। ছাত্র নেতাদের মধ্যে ত্যাগের রাজনীতি থেকে ভোগের রাজনীতির প্রভাব বেশি। আগে ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচন করা হত মেধা দেখে এখন ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয় টাকার বিনিময়ে। এর ফলে যে টাকার বিনিময়ে নেতা হয় সে তার টাকাগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য ছিনতাই, চাঁদাবাজি কিংবা টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়ে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এর থেকে উত্তরণের উপায় কি?

এর থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে, প্রকৃত ছাত্রদের হাতে নেতৃত্ব দিতে হবে। তার সঙ্গে সঙ্গে যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের ভোগের রাজনীতি ত্যাগ করে ত্যাগের রাজনীতি শুরু করতে হবে। যা আমাদের পূর্বসূরীরা করে গেছেন। এছাড়া বর্তমান ছাত্র নেতাদের প্রচুর পরিমাণে লেখাপড়া করতে হবে।

দেশের রাজনীতির ইতিহাস এবং পূর্বসূরীদের ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে জানতে হবে। ফলে ছাত্র নেতাদের উপর এর প্রভাব পড়বে বলে আমার বিশ্বাস। এর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র নেতাদের কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। কর্মীদের ত্যাগের রাজনীতির শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র রাজনীতির প্রকৃত আদর্শ ফিরিয়ে আনতে হবে। গ্রুপিং রাজনীতি কিংবা বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংঘর্ষের পথ পরিহার করতে হবে। কোনো অপ্রীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে তাদের গঠনতন্ত্রে ফিরে আসতে হবে। গঠনতন্ত্রে যেভাবে দলকে গঠন কিংবা দল পরিচালনার কথা বলা হয়েছে সেভাবে দল পরিচালিত করতে হবে। এতে করে দল তথা রাষ্ট্র, সমাজ, উপকৃত হবে। ছাত্র নেতাদের মধ্যে যদি ছাত্র রাজনীতির প্রকৃত আদর্শ ফিরে আসে তাহলে ছাত্র রাজনীতি তার সঠিক কক্ষপথে ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

 

লেখক:শিক্ষার্থী, এমসি কলেজ, সিলেট

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল - dainik shiksha স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047628879547119