উপযুক্ত সব স্কুল-কলেজ-মাদরাসা এমপিওভুক্ত করা সম্ভব

আমিরুল আলম খান |

শিক্ষামন্ত্রী ড.দীপু মনি সংসদকে জানিয়েছেন, এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক যোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। ১১ জুন জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে মন্ত্রী বলেন, দেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপকভাবে এগিয়ে গেছে। কাজেই আমাদের আর্থিক সামর্থ্যও আগের তুলনায় অনেক বেশি। এ কারণে এবার আগের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আমরা এমপিওভুক্ত করতে পারবো বলে আশা করছি। প্রত্যেক সংসদ সদস্যদের এলাকার মধ্যে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভালো ফল করছে তারা অবশ্যই এমপিওভুক্তির সুযোগ পাবে।

শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে বেসরকারি স্কুল কলেজ মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।  নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন তারা। পুরো নয় বছর বার বার আশা ভঙ্গের বেদনা সইতে হয়েছে তাদের। এবার মনে হচ্ছে, তাদের একটা হিল্লে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের পর নতুন এমপিওভুক্তি বন্ধ করে দেয়। মহাজোট সরকার তাদের ১০ বছরের শাসনকালে মাত্র একবার ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বেসরকারি শিক্ষকদের শেষ এমপিও দিয়েছিল। তারপর বার বার সরকার আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু এমপিও জোটেনি বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের।

এমপিও হলো মান্থলি পে অর্ডার। যত রকম অর্ডার সরকার জারি করে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিদঘুটে অর্ডার হল এই এমপিও। হর মাসে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের অর্ডার দেবে, মানে ব্যাংকে টাকা পাঠাবে, ঘটা করে তা আবার মিডিয়ায় প্রচার করবে। এটা হল স্রেফ সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা। যেন খয়রাত দেয়া! সরকারি কর্মচারীদের বেতন সরকার মাসে মাসে ঘটা করে দেয় না। বেতন দেবার বিধান আছে। সে মোতাবেক সবাই বেতন-ভাতা পায়। শুধু বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের বেলায় ভিন্ন নিয়ম। প্রতি মাসে তাদের বেতন-ভাতা দেয়া নিয়ে কত কাণ্ড দেশে।    

তাতেও বেজার নয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা। অন্তত পরের মাস, নির্দিষ্ট কোনো দিন তারিখ না হলেও, অন্তত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরি মেলে। কিন্তু তাদের সাথে সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ফারাক বহুত। যদিও মূল বেতনে ফারাক নেই এখন। তবে ফারাক আছে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতায়। ফারাক আছে আনুতোষিক আর পেনশনে। সে আলাদা কেচ্ছা।

আপাতত এমপিও জুটলেই খুশি তারা। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের পর বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য সরকার এমপিও দেয়নি। এমপিও নিয়ে বহুত গবেষণা হয়েছে দেশে। শেষে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে সরকার এমপিও সম্পর্কিত একটা নীতিমালা তৈরি করে। সে মোতাবেক অনলাইনে আবেদন করেছে প্রায় নয় হাজার স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে সরকার যাচাই-বাছাই করে নাকি হাজার দুয়েক প্রতিষ্ঠান পেয়েছে যেগুলোকে নীতিমালার অধীনে এমপিও দেয়া যায় বলে চিহ্নিত করা গেছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ আছে সরকারের ওপর। কিন্তু সংসদে শিক্ষামন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিলেন, চাপের কাছে সরকার নতি স্বীকার করবে না। তারা নীতিমালা মেনেই এমপিও দেবে। শিক্ষামন্ত্রীর অবস্থান স্পষ্ট। তিনি যদি তা রক্ষা করতে পারেন, তাহলে নিশ্চয়ই সকলে তাকে বাহবা দেবে। আমরা তার সাফল্য কামনা করি।

শিক্ষামন্ত্রী সংসদে আরও একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বেড়েছে। তাই সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করতে চান তিনি। সরকারের কাছে সব তথ্য আছে। যদি তা ঠিকভাবে বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে দীর্ঘকাল ধরে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে সব সমস্যা মোকাবেলা করে আসছে তার একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি। 

অনেকে বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো স্কুল-কলেজ-মাদরাসা গজিয়ে উঠেছে। কথাটা সত্য বটে; তবে আংশিক সত্য। আমাদের চাহিদার তুলনায় স্কুল-কলেজ কি সত্যিই খুব বেশি? বোধহয় না। তবে সমস্যা আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে। 

সরকারের নীতিমালার বাইরে যেসব স্কুল-কলেজ-মাদরাসা গড়ে উঠেছে সে দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কেননা গত দুই দশকে দেশে যে সব স্কুল-কলেজ-মাদরাসা সরকারের নীতিমালা লঙ্ঘন করে গড়ে উঠেছে তার অন্তত ৯০ ভাগ বোর্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপে। মন্ত্রণালয়ে সে সব নথি আছে। কাজেই মন্ত্রণালয় বেহুদা নাক গলিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় বা অন্য কোনো অজানা কারণে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দিতে বোর্ডকে বাধ্য করেছে সেসব স্বীকৃতির দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।
  
আমরা বহুবার লিখেছি, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠায় সরকারি নীতিমালা মেনে চলায় বড় বাধা শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বোর্ডগুলোকে তারা পোস্ট অফিস বানিয়ে সব ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ে কেন্দ্রীভূত করেছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নানা অনিয়ম। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে অনুমোদনের পর কেন তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হল না, সে প্রশ্ন সবার মনে। আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাচ্ছে কেন? কেন মাধ্যমিক শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করা যাচ্ছে না? কেন মাধ্যমিক স্তরে একমুখী শিক্ষা চালুর ন্যূনতম উদ্যোগ নেয়া হলো না? কেন সেই বৃটিশ আমলের কেরানি তৈরির কারখানা হয়ে রইল এদেশের স্কুল-কলেজ? কেন কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে দক্ষ জনসম্পদ তৈরির ব্যবস্থা করা গেল না? লাখ লাখ সার্টিফিকেটধারী কিন্তু অদক্ষ বেকার তরুণ যুবক সৃষ্টির দায় কার? এসব প্রশ্ন সবার মনে। 

যাই হোক, শিক্ষামন্ত্রী খুব জোরের সাথে বলেছেন, এবার সর্বাধিক সংখ্যক স্কুল-কলেজ-মাদরাসা এমপিও পাবে। এটি সরকারের খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা একে স্বাগত জানাই।

তবে, একটি কথা বলতে চাই। অন্তত পাঁচ বছর পূর্বে যেসব স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বোর্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে সেগুলোকে যেন এমপিওভুক্ত করা হয়। গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে সময়ে দেখেছি মাত্র হাজার দুয়েক কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ করা গেলে এমন সব স্কুল-কলেজ-মাদরাসা এমপিওভুক্ত করা সম্ভব। খবরে জানা যাচ্ছে, এবারের বাজেটে এ খাতে ১৫০০ কোটি টাকা আলাদা করে রাখা হচ্ছে। আর গত বছরের ১৫০০ কোটি টাকা নাকি অব্যবহৃত রয়েছে। এ তথ্য সঠিক হলে সরকারের কাছে ৩০০০ কোটি টাকা এ খাতে থাকার কথা। আমরা আশা করব, সরকার শিক্ষার কল্যাণে পুরো ৩০০০ কোটি টাকা ব্যয় করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জমে ওঠা ধুলো-ময়লা সাফ করে ফেলবে। সেক্ষেত্রে সব বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসাকেই এমপিও দেয়া সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।

অবশ্য টাকা থাকলেই তা খরচ করতে হবে, আমরা তা বলি না। কোনো রকম অপব্যয় করা উচিত নয়। তাই যেগুলো নীতিমালার মধ্যে পড়বে না সেগুলো সম্পর্কে সরকারের একটি স্পষ্ট নির্দেশনামালা প্রণয়ন করতে হবে। আবার দুর্বল বলে যেন কেউ বাদ না পড়ে। দুর্বলের প্রতিই সরকারের বেশি নজর দেয়া উচিত। দুর্গম এলাকার কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।  

সব শেষে বলতে চাই, এমপিও পাবার পর এসব প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। ক্লাসের পাঠ ক্লাসেই দিতে হবে। নিজেদের যোগ্য শিক্ষক হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। স্কুল-কলেজ থেকে কোচিং বিদায় দিতে হবে। কিন্তু তার মানে এটাও নয়, প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে কোচিং চালু থাকবে। ক্লাসে পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে যেন কোচিং করার কোনো দরকারই না হয়।   

সরকারের দায়িত্ব হবে, কঠোর হাতে কোচিং ব্যবসা বন্ধ করা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকার স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ যোগাবে, দালানকোঠা বানিয়ে দেবে, বিনা মূল্যে বই দেবে আর সেখানে লেখাপড়া হবে না, মানসম্মত শিক্ষাদান নিশ্চিত করা যাবে না এটা মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষা ক্ষেত্রে বহু জঞ্জাল জমেছে। সময় এসেছে সব জঞ্জাল সাফ করার।

লেখক: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0099389553070068