পাঠ্যবই মুদ্রণ সিন্ডিকেটের কবলে

রাকিব উদ্দিন |

আন্তর্জাতিক দরপত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ ঠেকাতে বাংলাদেশি ছাপাখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে সরকারের প্রায় ১৩০ কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। দ্বিতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করেও প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ফলে অস্বাভাবিক বেশি অর্থাৎ সরকারের প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা বেশি ব্যয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্রে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপাতে বাধ্য হচ্ছে এনসিটিবি। প্রেস মালিকরা সংঘবদ্ধভাবে চড়া দরে দরপত্র জমা দিয়েছেন। এতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজ পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক দরপত্রও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়নি।

বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণ ঠেকাতে টানা তিন বছর সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দরে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কাজ করেছেন দেশের ছাপাখানা মালিকরা (প্রিন্টার্স)। কিন্তু সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবার আগাম বই ছাপার উদ্যোগ নেয়ায় বেঁকে বসেছেন তারা। এবার বিপরীত অবস্থানে দেশের মুদ্রাকররা। অস্বাভাবিক বেশি দরে কাজ চান। ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের বই মুদ্রণে সরকার নির্ধারিত প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা বেশি টাকায় কাজ দিতে এনসিটিবি’কে ঠেকিয়ে দিয়েছে দেশের মুদ্রাকরা। এ কাজে মুদ্রাকরদের অনৈতিক পন্থায় সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে এনসিটিবির একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এদের পরামর্শেই মুদ্রাকররা জোটবদ্ধভাবে দর নির্ধারণ করে দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মুদ্রাকরদের সিন্ডিকেট ঠেকাতে অর্থাৎ প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশি মূল্যে দরপত্রের শিডিউল জমা পড়ায় এবার পুনঃদরপত্র (দ্বিতীয়বার দরপত্র) আহ্বান করা হয়েছে। এ যাত্রায় নানা অজুহাত ও কৌশল অবলম্বন করে আরও বেশি দামে শিডিউল জমা দিয়েছেন মুদ্রাকররা। এতে বেকায়দায় পরেছে এনসিটিবি। আসন্ন সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের সকল বই মুদ্রণ সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘পুনঃদরপত্রে যারা শিডিউল জমা দিয়েছেন সেগুলোর মূল্যায়ন কাজ এখনও শেষ হয়নি। এনসিটিবির মূল্যায়ন কমিটি এ নিয়ে কাজ করছেন।’

পুনঃদরপত্রে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশি দরে কাজ দিতে হবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। কারণ মূল্যায়ন কমিটি এখন চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ করছেন।’

এনসিটিবিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য এবার (২০১৯ শিক্ষাবর্ষের জন্য) প্রায় সাড়ে ১১ কোটি পাঠ্যবই মুদ্রণ করা হচ্ছে। ৯৮টি লটে এসব বই মুদ্রণ করা হচ্ছে। এনসিটিবি এসব বই ছাপাতে ফর্মা প্রতি প্রাক্কলিত ব্যয় ২ টাকা ২৫ পয়সা নির্ধারণ করেছে, যা মোট প্রায় ৩৫৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

কিন্তু ১২ এপ্রিল দরপত্র উন্মক্ত করে দেখা যায়, মুদ্রাকর ও প্রকাশকরা ফর্মা প্রতি দাম ধরেছেন ২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে দুই টাকা ৮২ পয়সা। এতে মোট ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা, যা প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ১১১ কোটি টাকা বেশি।

এজন্য এনসিটিবি প্রাক্কলিত ব্যয় কিছুটা বাড়িয়ে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে। পুনঃদরপত্রে প্রতি ফর্মার জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২ টাকা ৬৯ পয়সা। কিন্তু গত ২০ ও ২১ জুন পুনঃদরপত্র উন্মুক্ত করে দেখা যায়, মুদ্রাকররা জোটবদ্ধভাবে বই ছাপার ব্যয় আরও বেশি ধরেছেন। তারা ফর্মা প্রতি বই মুদ্রণের ব্যয় ২টাকা ৯০ পয়সা দরে দরপত্র জমা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী বই ছাপালে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে সরকারের প্রায় ১৩০ কোটি টাকা বেশি খরচ হবে। দ্বিতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করতে ৪২ দিন সময় নষ্ট হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (টেক্স্ট) ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য প্রফেসর ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকী (রতন সিদ্দিকী) বলেন, ‘দরপত্র মূল্যায়ন কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন ফিল্ড ভিজিট (ছাপাখানার অবকাঠামো পরিদর্শন) চলছে।’

প্রাক্কলিত বেশি দরের চেয়ে বেশি দরে কাজ দেয়া হচ্ছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, এবার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ১০ শতাংশ কিংবা ১৮ শতাংশ বেশি দরে কাজ দিতে হতে পারে। কারণ এবার বিশ্বে কাগজের দাম কিছুটা বেশি।’

কাগজ, কালি ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় উপকরণের বাজারদর বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করা হলে এখন আবার দর বাড়বে কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘এখন আমাদের কিছু করার নেই। খরচ একটু বেশি পড়ছে।’

২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সাদা কাগজে প্রাথমিক স্তরের চার রঙের বই ছাপা হচ্ছে। ওই সময় থেকে ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি ছাপাখানা দরপত্রে অংশ নেয়া শুরু করে। পরবর্তীতে ভারতের কয়েকটি ছাপাখানা নিয়মিত অংশ নিলেও তারা কাজ পেয়েছে দু’তিন বছর। তাদের ছাপানো বইয়ের মানও বেশ ভালো ছিল।

পরবর্তীতে দেশীয় প্রকাশকরা বিদেশি ছাপাখানায় বই ছাপতে দেয়ার বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামেন। তাদের দাবি, দেশের ছাপাখানা শিল্প ধ্বংস হচ্ছে। আর সরকারের যুক্তি ছিল, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজ হলে পাঠ্যবইয়ের মান ভালো হয়।

কিন্তু বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ ঠেকাতে ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিত সরকারের প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বই ছাপার দরপত্র জমা দিয়ে আসছেন দেশের মুদ্রাকর ও প্রকাশকরা। এতে নির্ধারিত সময়ে বই ছাপাতে মুদ্রাকরদের অক্ষমতার পাশাপাশি বইয়ের কাগজ ও কালির মান নিচে নামতে থাকে।

এনসিটিবিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিকের পাঠ্যবই মুদ্রণ কাজে বিদেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ ঠেকাতে দেশের ২০/২২টি প্রতিষ্ঠান সঙ্গবদ্ধভাবে সরকারের প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ফর্মা প্রতি ৩২ থেকে ৪২ শতাংশ কম দরে দরপত্র জমা দিয়ে কাজ ভাগিয়ে নেয়। এরপর তারা পাঠ্যবইয়ে নিম্নমানের কাগজ, কালি ব্যবহার করেন।

এনসিটিবি ২০১৪ সালের দরপত্র এবং ২০১৫ সালের বাজারদর পর্যালোচনা করে ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের বই মুদ্রণের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে মোট ৩৩০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০/২২টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান সঙ্গবদ্ধভাবে সব কাজ ভাগিয়ে নিতে মাত্র ২২১ কোটি টাকায় কাজ করার দরপত্র জমা দেয়। পরবর্তীতে এসব প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দিতে বাধ্য হয় এনসিটিবি। কিন্তু নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই বইয়ের ছাপা, বাঁধাই ও কালির মান নিয়ে প্রশ্ন। ঘষা লাগলেই কালি ওঠে যায়।

২০১৮ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাজে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ঠেকিয়ে সরকারের প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা কম দর দিয়ে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজ নেয় দেশের ৩২টি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠান। ওই বছর প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২৭৭ কোটি টাকা। আর ৩২টি প্রতিষ্ঠান মাত্র ২৩৭ কোটি টাকায় কাজ ভাগিয়ে নেয়।

এভাবে প্রতি বছরই কাজ ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে দেশীয় কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও ছাপাখানার বিরুদ্ধে। প্রায় প্রতি বছর এনসিটিবির মনিটরিং এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর নিয়োজিত পাঠ্যবইয়ের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত সংস্থার প্রতিবেদনে ‘নিম্নমানের বই’ ছাপার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে আসছে।

এই অপরাধে এনসিটিবি কেবল নামকাওয়াস্তে ওইসব ছাপাখানা ও প্রকাশনা সংস্থাকে কিছুটা আর্থিক জরিমানা করে আসছে। কিন্তু ওইসব ছাপাখানা ও প্রকাশনা সংস্থার মালিক একই পন্থায় নিয়মিত কাজও ভাগিয়ে নিচ্ছেন। এবার ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের বই মুদ্রণ কাজও ওইসব প্রতিষ্ঠান পাচ্ছেন বলে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সূত্র: সংবাদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025589466094971