শিক্ষা বোর্ডগুলো এইচএসসি ও সমপর্যায়ের পরীক্ষার ফল প্রকাশের কৌশল নির্ধারণে দফায় দফায় বৈঠক করছে। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড একসঙ্গে এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পৃথকভাবে ‘গ্রেডিং’য়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ করছেন। তবে এ বিষয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণে গত ৭ অক্টোবর একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়া হলেও গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। ফলে কমিটির কার্যক্রমও শুরু হয়নি। বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, যেসব শিক্ষা শিক্ষার্থীর জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমপর্যায়ের পরীক্ষায় দুটি জিপিএ-৫ রয়েছে সেসব শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেতে যাচ্ছে-এমনটাই মনে করছেন শিক্ষা বোর্ডগুলোর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মকর্তারা। শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যে এইচএসসির ফল প্রকাশ করে জানুয়ারিতে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন। এদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ৭৯ হাজার ১৭১ জন এবং অনিয়মিত পরীক্ষার্থী দুই লাখ ৬৬ হাজার ৫০১ জন।
আবার অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও নানা রকম ভাগ রয়েছে। তাদের মধ্যে এক বিষয়ে যারা অনুত্তীর্ণ হয়েছিল তাদের সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার ৯২৯ জন, দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ২২৪ জন এবং সব বিষয়ে অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৫১ হাজার ৩৪১ জন। নিয়মিত ও অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের বাইরে সংখ্যা তিন হাজার ৩৯০ জন। ফলাফল উন্নয়নের জন্য আবারও পরীক্ষায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৭২৭ জন। মূলত, ওইসব শিক্ষার্থীর গ্রেডিং নির্ধারণের ‘ক্রাইটেরিয়া’ নিয়েই শিক্ষা বোর্ডগুলো একের পর বৈঠকে বসছেন।
ফলাফল মূল্যায়নের প্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণক প্রফেসর এসএম আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী যেভাবে বলেছেন আমরা সেভাবেই কাজ করছি; জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হবে। যেসব শিক্ষার্থীর দুটি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ রয়েছে, তারা হয়তো জিপিএ-৫ পাবে। তবে কোন শিক্ষার্থীই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
গ্রেডিং নির্ধারণের ‘ক্রাইটেরিয়া’ প্রণয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে কাজ করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। তারাই ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করবেন। পাশাপাশি আমরাও কাজ করছি; কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডও আলাদাভাবে একাডেমিক ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে উপর্যপুরি বৈঠক করছেন। তবে কোন কিছুই এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত ৭ অক্টোবর এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে বলেন, ‘২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা সরাসরি গ্রহণ না করে ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরা দুটি পাবলিক পরীক্ষা অতিক্রম করে এসেছে। এদের জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) ও এসএসসির ফলের গড় অনুযায়ী এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হবে।’
গতবার যারা ফেল করেছে, তাদেরও জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘অনেক এসএসএসি পরীক্ষার্থী এইচএসসিতে ভিন্ন বিভাগে যান। সেক্ষেত্রে তাদের বিষয়ে কী হবে সেজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’ ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এইচএসসির চূড়ান্ত মূল্যায়ন ঘোষণা করতে চাই জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘যাতে জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে পরামর্শক কমিটিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্বপালন করবেন। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের প্রতিনিধি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।
উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশে পরামর্শক কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হক খান গতকাল বলেন, ‘এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু শুরু হয়নি। বৈঠকও হয়নি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কমিটির সদস্য সচিব; তিনি ভালো বলতে পারবেন। আর কমিটি গঠন হলে পিআরও (জনসংযোগ কর্মকর্তা) সাহেব সবাইকে জানাবেন।’ তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পিআরও মোহাম্মদ আবুল খায়ের গতকাল রাতে জানান, কমিটি গঠনের আদেশ তিনি পাননি।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘কোন নীতি অনুসরণ করে ফলাফল নির্ধারিত হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া না হলেও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের কাজ করা হচ্ছে।’
জানা গেছে, পরামর্শক কমিটির পরামর্শে বিভাগ পরিবর্তনকারী পরীক্ষার্থীদের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিভাগ পরিবর্তনজনিত (যারা বিজ্ঞান থেকে মানবিক বা অন্য বিভাগ পরিবর্তন করেছে) কারণে যে সমস্যাটি হতে পারে তা ঠিক করতে বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করবে।
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, এসএসসি ও সমপর্যায় এবং এইচএসসি ও সমপর্যায় পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়, কোন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার যোগ্যতা আছে কি না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলও নির্ভর করে এই দুই পাবলিক পরীক্ষার ফলের ওপর। ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে পড়তে চাইলে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিতের মতো কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম গ্রেড প্রয়োজন হয়। এ কারণে পরীক্ষা না নিয়ে জেএসসি ও এসএসসির ফলের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসির ফল দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে জটিলতা তৈরির আশঙ্কা থেকেই যায়। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ করছে শিক্ষা বোর্ডগুলো।
এ ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশ থেকে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় তারা শুধু দেখে যে শিক্ষার্থী টুয়েলভ গ্রেড পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে কিনা। এরপর শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিই অবলম্বন করে। পৃথিবীতে অনেক জায়গাতেই করোনা মহামারীর কারণে পাবলিক পরীক্ষা বা এক্সিট এক্সামগুলো নেয়া সম্ভব হয়নি। কাজেই আমাদের শিক্ষার্থীদের ভিন্নভাবে যাচাই করা হবে বলে আমার মনে হয় না।’