প্রায় এক বছর ধরে রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (রামেবি) ক্যাম্পাসে নিয়মিত অফিস করছেন না উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মাসুম হাবিব। গত ছয় মাসে ৩০ দিনও রাজশাহীতে অফিস করেননি তিনি। ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিস খুলে সেখানেই রামেবির কাজ সারেন। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র লঙ্ঘন করে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে গোপনে রামেবির আওতায় সেই তিনটি বেসরকারি নার্সিং কলেজকে ৬০টি আসন বৃদ্ধির অনুমোদন, জামায়াতের তালিকাভুক্ত ক্যাডারদের নিয়োগ দেয়াসহ ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। রাজশাহী আওয়ামী লীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েছেন উপাচার্য। মূলত এসব কারণে উপাচার্য রাজশাহীতে অফিস করছেন না বলে সূত্র জানায়। বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রফিকুল ইসলাম।
অবৈধভাবে আসন বৃদ্ধি করা প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো বগুড়ার টিএমএসএস নার্সিং কলেজ, রংপুর কমিউনিটি নার্সিং কলেজ ও রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক নার্সিং কলেজ। ইসলামী ব্যাংক নার্সিং কলেজের ৩০টি এবং অন্য দুটির ১৫টি করে আসন বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের ১৮ এপ্রিল এই তিনটি প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর সম্প্রতি গোপনে রামেবির উপাচার্য প্রতিষ্ঠান তিনটিকে আসন বৃদ্ধির অনুমোদন দেন।
নিয়মানুযায়ী আসন বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রথমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেবে। এরপর নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে নির্ধারিত ফিসহ রামেবি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবে। আবেদনপ্রাপ্তির পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আসনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পরিদর্শনদল গঠন করবে। পরিদর্শনদল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে আসনসংখ্যা বৃদ্ধি যৌক্তিকতা মনে করলে সুপারিশ করবে। এ সুপারিশের আলোকে উপাচার্য আসনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুমোদন অথবা নাকচ করতে পারেন। কিন্তু এ নিয়ম লঙ্ঘন করে তিনটি প্রতিষ্ঠানই আগেই শিক্ষার্থী ভর্তি করে।
জানতে চাইলে রামেবির উপাচার্য মাসুম হাবিব বলেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়মানুযায়ী জরিমানা আদায়ের পর আসন বৃদ্ধির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, পরিদর্শন ও জরিমানা ছাড়াই ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে মুচলেকা নিয়ে উপাচার্য আসন বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছেন।
সূত্র আরও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তির অপরাধে এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজকে এক কোটি এবং শাহ্ মখদুম মেডিক্যাল কলেজকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করে। কিন্তু রামেবির উপাচার্য সে পথে না গিয়ে উৎকোচ নিয়ে ওই তিন নার্সিং কলেজকে আসন বৃদ্ধির অনুমোদন দেন। এটি ও নিয়োগ নিয়ে বিরোধের জেরে ঢাকায় অফিস করছেন উপাচার্য। ঢাকার নবোদয় হাউজিং সোসাইটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ অফিস খুলে সেখানেই বেশির ভাগ সময় কাটান তিনি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও সেখানে অফিস করতে হয়। অনেকেই বলেন, উপাচার্য রামেবিকে ঢামেবিতে (ঢাকা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) পরিণত করেছেন। ঢাকার মিরপুরে ‘চৌরঙ্গী অপটিকসে’ তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও (চোখের চিকিৎসা) করেন। ফলে রাজশাহী অফিসে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই।
রামেবির একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, প্রায় এক বছর ধরে উপাচার্য রামেবির প্রধান কার্যালয়ে আসেননি। গত ছয় মাসে তিনি ৩০ দিনও রাজশাহীতে অফিস করেননি। প্রয়োজনে এখানকার কর্মকর্তাদের ঢাকায় ডেকে নিয়ে কাজ সারেন তিনি। আবার কখনো রাজশাহী এলেও তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার জন্য বিল করে থাকেন। সম্প্রতি রামেবিতে নিয়োগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভ এবং রাজশাহী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে মূলত রাজশাহীতে আসেন না উপাচার্য।
অভিযোগ রয়েছে, রামেবিতে এখন পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশকে আগেই অ্যাডহকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের ব্যবস্থা করেন উপাচার্য। এটি করতে গিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত করেছেন। সব মিলিয়ে গত দুই বছরে তিনি অন্তত ৫০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। অন্তত ৪০ জনকে আগেই অ্যাডহকে ও বাকি ১০ জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। প্রথমেই ৩২ জনকে অ্যাডহকে নিয়োগ দেন উপাচার্য মাসুম হাবিব। ঢালাওভাবে অ্যাডহকে নিয়োগ দিয়ে পরে চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন উপাচার্যকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে। তাঁর অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর পরও অ্যাডহকে নিয়োগপ্রাপ্তদের (উপাচার্যের পছন্দের লোক) নিয়োগ দেয়া হয় নামমাত্র পরীক্ষা নিয়ে। এ নিয়ে সিন্ডিকেট সভাতেও আপত্তি তোলা হয়। উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতায় বিএনপি-জামায়াতের একাধিক নেতাকর্মী নিয়োগ পাওয়ায় বছরখানেক আগে তাঁর কার্যালয়ে তাঁকে লাঞ্ছিতও করে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘আমি কোনো নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা সবাই যোগ্য ব্যক্তি। আর ঢাকায় মন্ত্রণালয়ে কাজ থাকায় আমি ঢাকায় থাকি বেশির ভাগ সময়।’