শতাধিক হাইস্কুলেএক শিফটের শিক্ষক দিয়ে চলছে ডাবল শিফট

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এক শিফটেরও কম শিক্ষক দিয়ে চলছে রাজধানীর বাইরের ডাবল শিফটের সরকারি হাইস্কুলগুলো। শিক্ষক-কর্মচারীর প্রয়োজনীয় পদ সৃজনের উদ্যোগ না নিয়ে নতুন সরকারি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করার কারণে চরম শিক্ষক সংকটে পড়েছে সারাদেশের ডাবল শিফটের শতাধিক হাইস্কুল। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৮/১০ জন শিক্ষক দিয়ে ডাবল শিফটের স্কুলগুলো নামেমাত্র পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে গড়ে প্রায় অর্ধেক শ্রেণীকার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে; শিক্ষক না থাকায় বাকি অর্ধেক শ্রেণীকার্যক্রম ঠিকমতো চলছে না। তবে ঢাকার ২১টি ডাবল শিফটের হাইস্কুলে শিক্ষক স্বল্পতা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। এছাড়াও কর্মচারী স্বল্পতা, অবকাঠামো সীমাবদ্ধতা এবং শিক্ষকদের বিভিন্ন সরকারি প্রয়োজনে দায়িত্বপালনে বাধ্য করার কারণেও একাডেমিক কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ছে। এজন্য শিক্ষার্থীরা শ্রেণী শিক্ষকের বাসায় কোচিংয়ে ভর্তি, প্রাইভেট টিউটর রাখা ও বাণিজ্য নির্ভর কোচিং সেন্টারের দ্বারস্থ হচ্ছে। সারাদেশের ১৫৫টি ডাবল শিফটের হাইস্কুলে প্রায় একই ধরনের সংকট বিরাজ করছে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চ অধিদফতরের (মাউশি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।  ‍বৃহস্পতিবার  (২৫ এপ্রিল) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।

মাউশি অধিদফতর জানায়, জাতীয়করণের প্রক্রিয়াধীন ছাড়া বর্তমানে সারাদেশে সরকারি হাইস্কুল রয়েছে ৩৪৩টি। এর মধ্যে ডাবল শিফট চালু রয়েছে ১৫৫টি স্কুলে, যার ২১টি রাজধানীতে; এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক স্বল্পতা খুব বেশি নেই। আর ৩৪৩টি প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষকের মোট পদ রয়েছে ১০ হাজার ২৪৪টি। এরমধ্যে শিক্ষক আছেন প্রায় সাড়ে আট হাজার। আর শূন্য রয়েছে প্রায় দেড় হাজার পদ, যার বেশিরভাগই উপজেলা পর্যায়ের স্কুলের।

মাউশি অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশের সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকার ২২৬টি পদ শূন্য রয়েছে। আর জেলা শিক্ষা অফিসারের পদ ২৪টি, সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসারের ১২টি, সহকারী প্রধান শিক্ষকের ১১৫টি, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের ৩৩৫টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে সরকারি হাইস্কুল ও কলেজে বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী, পিয়ন, এমএলএসএস-এর পাঁচ হাজার ৫৬৫টি পদ শূন্য রয়েছে।

জানতে চাইলে মাউশি অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক সাখায়েত হোসেন বিশ্বাস  বলেন, ‘সব প্রতিষ্ঠানেই কম-বেশি শিক্ষক সংকট রয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।’

শিক্ষক স্বল্পতার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলের শিক্ষক নিয়োগ দিত। শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির কারণে এখন পিএসসির মাধ্যমে দিতে হচ্ছে।’

ঢাকা কলেজিয়েট হাইস্কুলের দু’জন শিক্ষক  বলেন, ‘শুধু ডাবল শিফট নয়, এক শিফটের স্কুলেও শিক্ষক সংকট রয়েছে। কারণ গত ৭ বছর ধরে হাইস্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। কলেজিয়েট হাইস্কুল এক শিফটের, এখানেও চারটি পদ শূন্য।’

ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূইয়া  জানান, দুই শিফটের এ স্কুলে শিক্ষক আছেন ৫০ জন। এই স্কুলে একাদশ শ্রেণীও (কলেজ শাখা) চালু রয়েছে। এই স্তরে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ’। অথচ এদের জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র একজন (প্রভাষক)। এজন্য স্কুল শিক্ষকদেরই একাদশ শ্রেণীর ক্লাস নিতে হচ্ছে।

মাউশির তথ্যানুযায়ী, সদ্য জাতীয়করণের প্রক্রিয়াধীন প্রতিষ্ঠান ছাড়া বর্তমানে দেশে মোট সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৪৩টি। এরমধ্যে ৭০টি হাইস্কুলে আগে থেকেই ডাবল শিফট চালু ছিল। ২০০৯ সালে দেশের ৮৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ডাবল শিফট চালুর উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়; যা ২০১০ সালে কার্যকর হয়। এজন্য নতুন করে এক হাজার ৯৬৮ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১১ সালে।

পরবর্তীতে এসব স্কুলে সরাসরি আর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। বিসিএস পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ কিন্তু পদ স্বল্পতায় ক্যাডার পদে নিয়োগ না পাওয়া প্রার্থীদের মধ্য থেকে নন-ক্যাডার হিসেবে সরকারি হাইস্কুলগুলোতে সীমিত সংখ্যাক শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছে, যা দিয়ে সংকট কাটছে না। পর্যায়ক্রমে শিক্ষক স্বল্পতা তীব্র হচ্ছে। এ কারণে অধিকাংশ ডাবল শিফটের স্কুল ডামি শিক্ষক অর্থাৎ বাংলার শিক্ষক দিয়ে ইংরেজি, সমাজের শিক্ষক দিয়ে গণিত ও অন্যান্য বিষয় পাঠদান করা হচ্ছে।

স্কুলগুলোতে শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি কর্মচারী সংকটও তীব্র হচ্ছে। বেশিরভাগ স্কুলেই অফিস সহকারী ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নেই। এই সমস্যা সামাল দিতে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে শ্রমিক দিয়ে স্কুলে জরুরি কার্যক্রম চালাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ডাবল শিফটের স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষককে প্রতিদিন কমপক্ষে ১টি করে ক্লাস বেশি নিতে হয়। সপ্তাহে একজন শিক্ষকের সর্বোচ্চ ১৮টি ক্লাস নেয়ার নিয়ম থাকলেও তাদের নিতে হয় ২২ থেকে ২৫টি ক্লাস। তবে গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত ক্লাস নিতে অনিহা প্রকাশ করেন। কারণ নিয়মিত পাঠদানের বাইরে তারা প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে পাঠদানে ব্যস্ত থাকেন।

মাউশি অধিদফতর সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই প্রধান শিক্ষক নিজেদের প্রতিষ্ঠানে জরুরিভিত্তিতে কয়েকজন শিক্ষক পদায়নের অনুরোধ করেছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভৌত বিজ্ঞান (পদার্থ), জীব বিজ্ঞান ও ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে কোন শিক্ষক নেই।

আর মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন নাহার শাহীন চিঠিতে বলেছেন, ‘বিদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক সহকারী শিক্ষকের চারটি পদ এক বছর ধরে শূন্য আছে। দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয়ে সুষ্ঠুভাবে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা ব্যাহত হচ্ছে।’ তার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলা বিষয়ে ২টি, জীব বিজ্ঞান একটি এবং শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের একটি পদ শূন্য রয়েছে।

জয়পুরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিলকিস সালাম জানান, ‘দু’জন সহকারী প্রধান শিক্ষক ও একজন প্রধান শিক্ষক ছাড়াও এক শিফটের স্কুলে ২৫ জন এবং দুই শিফটের স্কুলে ৫৩ জন শিক্ষকের পদ রয়েছে। জেলা সদরে অবস্থিত এই স্কুলে শিক্ষার্থী রয়েছে ১২শ’-এর বেশি। অথচ শিক্ষকের ১৩টি পদ দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা রয়েছে।’

মাউশির তথ্য অনুযায়ী, তুলনামূলকভাবে রাজধানীর সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারীর স্বল্পতা কিছুটা কম থাকলেও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্কুলগুলোতে এই সংকট তীব্র রূপ নিচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ের প্রায় অর্ধশত সরকারি হাইস্কুল পরিচালিত হচ্ছে পদের চেয়ে অর্ধেকেরও কম সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক স্বল্পতায় ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট কোচিংয়ের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023820400238037