এক সার্টিফিকেটের পেছনেই ৩৪ বছর!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সাধারণত সবারই স্বপ্ন থাকে পড়ালেখা শেষ হবে, এরপর শুরু হবে কর্মজীবন। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদের জীবনটা সম্পূর্ণই ভিন্ন। পড়ালেখা শেষে বন্ধুরা যখন একে একে চাকরিতে ঢুকতে লাগলেন, তখন তাঁকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ৩৪ বছর ধরেই তিনি দৌড়াচ্ছেন এলএলবির সার্টিফিকেট এবং এর ক্ষতিপূরণের পেছনে। ১৭ বছর আইনি লড়াইয়ের পর হাতে পেয়েছেন সার্টিফিকেট। এরপর আরো ১৭ বছর ধরে দৌড়াচ্ছেন ক্ষতিপূরণের পেছনে।

জানা যায়, মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত যশোরের শহীদ মশিউর রহমান কলেজ থেকে এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল ফল প্রকাশিত হলেও উত্তীর্ণ তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। পরে তিনি নম্বরপত্রে দেখতে পান, একটি বিষয়ে পাস মার্কের চেয়ে ১ নম্বর কম পেয়েছেন। এরপর তিনি উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন চলে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করেনি।

ফলে ওই বছরের শেষ দিকে তিনি যশোরের সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা করেন। এরপর ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে  পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশের নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন আদালত। তবে সেই রায়ের ব্যাপারে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে যশোরের জেলা জজ আদালতে আপিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সেই আপিল খারিজ করে দেন আদালত। পরে হাইকোর্টে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

তবে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বোচ্চ আদালতও আপিলটি খারিজ করে দেন। একই সঙ্গে পুনর্নিরীক্ষার আবেদনের ফল প্রকাশ করার নির্দেশনার পাশাপাশি আবেদনকারী মামলার খরচ প্রাপ্তির অধিকারী বলেও ঘোষণা দেন আদালত। তবে এরপর আর সুপ্রিম কোর্টে যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়।

তাতে মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তখন তিনি মামলার খরচ বাবদ ১০ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন, বর্তমান হিসাবে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক আরো কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠান তিনি।

জানা যায়, মুন্সী মহিউদ্দিন আহমেদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর স্বপ্ন ছিল তিনি আইনজীবী হবেন। কিন্তু ফল নিয়ে মামলা লড়তে গিয়ে তাঁর আর কিছুই করা হয়নি। ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তবে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর অ্যাডভোকেট হিসেবে কিছুদিন কাজ শুরু করলেও তা তেমনভাবে এগোয়নি। মূলত পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশের মামলার পেছনেই চলে গেছে তাঁর ১৭ বছর। আর পরের ১৭ বছর তিনি মামলার খরচ এবং বর্তমানে ক্ষতিপূরণের টাকার পেছনে ছুটছেন।

মহিউদ্দীন আহমেদ বর্তমানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী। গত কয়েক বছর ধরে তিনি বিছানায়ই দিন কাটাচ্ছেন। তবে এখনো তিনি হাল ছাড়েননি। তাঁর ছেলে আসিফ শাহরিয়ার আহমেদ বর্তমানে বাবার হয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য ছুটছেন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একাধিক চিঠিও দিয়েছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর পাচ্ছেন না। অবশেষে বাধ্য হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে চিঠি দিয়েছেন আসিফ।

আসিফ শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, ‘আমার বাবার আত্মবিশ্বাস ছিল, তিনি ফেল করতে পারেন না। অবশেষে সেই আত্মবিশ্বাস সত্যি হয়েছে। কিন্তু তাঁর জীবন থেকে কেটে গেছে ১৭টি বছর। একজন মানুষের জীবনে ওই বছরগুলোই হলো কাজ করার সময়।

অথচ আমার বাবার মূল্যবান সময় পার হয়েছে মামলার পেছনে। তাই আদালত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছেন। যেহেতু আমার বাবা শারীরিকভাবে অসুস্থ, তাঁর পক্ষে আর ক্ষতিপূরণের পেছনে দৌড়ানো সম্ভব নয়, তাই আমি হাল ধরেছি।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. এম এ বারী বলেন, ‘মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদের ব্যাপারটি আমি বিস্তারিত জানি না। তবে ফল প্রকাশের কোনো সমস্যার কারণে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নজির আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এর পরও যথাযথভাবে তাদের আবেদন পেলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল সেলের দ্বারস্থ হব। তাদের পরামর্শ অনুযায়ীই পরবর্তীপদক্ষেপ গ্রহণ করব।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030081272125244