একমূখী শিক্ষার বিরুদ্ধে লেখালেখিগুলোয় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

আমি আমার জীবনে মাত্র একবার শিক্ষক-ছাত্রদের নিয়ে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করেছিলাম। সেই আন্দোলনের কারণে তিন মাসের ভিতর সরকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিল। আন্দোলন শুরু করার পর দেশের সব পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল, ছাত্র, শিক্ষক-অভিভাবক আমাদের সাহায্য করেছিল। সে জন্য এত তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের দাবি আদায় করতে পেরেছিলাম। সেটি ছিল ২০০৫ সাল এবং আন্দোলনটি ছিল একমুখী শিক্ষার বিরুদ্ধে।

একমুখী শিক্ষা বলতে আসলে বোঝানোর কথা ইংরেজি মিডিয়াম, মাদ্রাসা ও বাংলা মিডিয়াম—সবাইকে নিয়ে সমন্বিত একটা শিক্ষাব্যবস্থা। আমরা সবাই সেটা চাই কিন্তু ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের একমুখী শিক্ষা ছিল এক ধরনের প্রতারণা, সেখানে ইংরেজি মিডিয়াম ও মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন না করে শুধু মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমাদের দেশে এসএসসি পরীক্ষার যে কাঠামোটি ১৯৬৩ সাল থেকে চলে আসছিল, সেখানে নবম দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ভাগ হয়ে যেতো। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে একমুখী শিক্ষা চালু করার সময় এই ভাগগুলো তুলে দিয়ে সবাইকে একই বিষয় পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনেক কারণে এই একমুখী শিক্ষা দেশের শিক্ষকদের বাধার সামনে পড়ে।

প্রথম কারণটি হচ্ছে সরকারের গোপনীয়তা−একেবারে হঠাৎ করে দেশের মানুষ জানতে পেয়েছে যে, পরের বছর থেকে একমুখী শিক্ষা চালু হয়ে যাচ্ছে। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত দেশের কোনও মানুষকে না জানিয়ে চালু হতে যাচ্ছে, সেটি ছিল একটি রহস্য। মজার ব্যাপার হলো, আমরা এটি সম্পর্কে না জানলেও গাইড বইয়ের প্রকাশকেরা কিন্তু সেটি ঠিকই জানতো এবং তারা সব গাইড বই ছাপিয়ে ফেলেছিল। (পরে শুনেছি একমুখী শিক্ষা বন্ধ হওয়ার কারণে তাদের নাকি হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছিল!)।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, একমুখী শিক্ষার বিষয় নির্বাচন, সবার জন্য ১০০ মার্কসের ধর্ম এবং ১০০ মার্কসের ব্যবসায় শিক্ষা বাধ্যতামূলক কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩৭.৫ মার্কস করে! অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীরা যতটুকু পদার্থবিজ্ঞান (কিংবা রসায়ন) শিখবে তার থেকে তিনগুণ তাদের ধর্ম কিংবা ব্যবসায় শিক্ষা শিখতে হবে। অন্যান্য বিষয়ের গুরুত্বও ছিল খাপছাড়া। যদিও আধুনিক পৃথিবীর ভিত্তি হচ্ছে গণিত আর বিজ্ঞান কিন্তু একমুখী শিক্ষায় পুরো বিজ্ঞান শিক্ষার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

তৃতীয় কারণ হচ্ছে শিক্ষকদের হাতের ত্রিশ মার্কস। আমরা সবাই জানি শিক্ষকদের হাতে যে মার্কস দেওয়া হয় সেটি কখনও সঠিকভাবে দেওয়া হয় না−এখনো যে ব্যবহারিক পরীক্ষার মার্কস দেওয়া হয়, সেখানে সবাই ঢালাওভাবে সব মার্কস পেয়ে যায়, আসল মূল্যায়নের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। পাস মার্কস ৩৩, কাজেই শিক্ষকেরা যদি মায়া করে তাদের ছাত্রছাত্রীদের ৩০ মার্কস দিয়ে দেন এবং ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার সময় এমসিকিউ অংশে চোখ বন্ধ করে কিছু গোল্লা ভরাট করে চলে আসে তাহলেই ঘটনাক্রমে কিছু শুদ্ধ গোল্লা ভরাট হয়ে বাকি তিন মার্কস চলে আসবে! অর্থাৎ একেবারে একটি শব্দও না জেনে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর এসএসসি পরীক্ষা পাস করে ফেলা সম্ভব!

চতুর্থ কারণ হচ্ছে শিক্ষার ধারাবাহিকতা নষ্ট হওয়া। এসএসসিতে ছেলেমেয়েরা যদি বিজ্ঞান বলতে গেলে কিছুই না শিখে তাহলে এইচএসসি-এর সিলেবাসটিকেও কমিয়ে ফেলতে হবে, দুর্বল করে ফেলতে হবে। অর্থাৎ এই দেশের কোনও ছেলেমেয়েই ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিজ্ঞানের কোনও বিষয় শেখার মতো প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে না।

পঞ্চম কারণ হচ্ছে, যদিও মুখে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার চাপ কমানোর কথা বলা হয়েছিল কিন্তু হিসাব করে দেখা গেছে, একমুখী শিক্ষায় প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় মিলে ১৮টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয় শিখতে হবে। শুধু তা-ই নয়, ১৮টি বিষয়ের বাইরে এই নতুন পদ্ধতিতে মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের আরবি, হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের সংস্কৃত এবং বৌদ্ধ ছাত্রছাত্রীদের পালি ভাষা শিখতে হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সংস্কৃত কিংবা পালি ভাষার শিক্ষক কারা হবেন সে বিষয়ে কারো কোনও ধারণা কিংবা পরিকল্পনা নেই। (সেটি ছিল বিএনপি-জামায়াতের কাল, তখন সাম্প্রদায়িকতার একটি চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছিলাম। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কিংবা অন্য ধর্মের মানুষের ছেলেমেয়েরা চুলোয় যাক তাদের নিয়ে কেন মাথা ঘামাতে হবে−সেটি ছিল সেই সময়ে দেশের ফিলোসফি!)

তখন নানা ধরনের ষড়যন্ত্র থিওরিও বাজারে চালু ছিল, তার একটি হচ্ছে এরকম: যেহেতু মাদ্রাসা শিক্ষাকে উন্নত করে মাধ্যমিক শিক্ষার সমান করা যাচ্ছে না, তাই মাধ্যমিক শিক্ষাকেই অবনত করে মাদ্রাসা শিক্ষার সমান করে ফেলা হোক। আমি এই থিওরি বিশ্বাস করিনি কিন্তু একজন পরিচিত মানুষের বাসায় গিয়ে টেলিভিশনে হঠাৎ সেই সময়ের শিক্ষামন্ত্রীর একটা কথা শুনে একেবারে ‘থ’ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি নিজের কানে শুনলাম তিনি বললেন, স্কুলের শিক্ষাকে মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য একমুখী শিক্ষা চালু করা হচ্ছে। ষড়যন্ত্র থিওরি নয়, রীতিমত ষড়যন্ত্র!

যাই হোক ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের সেই সময়টিতে একমুখী শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের অনেক কিছু ঘটেছিল এবং আমি আন্দোলনের অংশ হিসেবে তখন পত্রপত্রিকায় সেগুলো নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছিলাম। সেই লেখালেখিগুলোয় অনেক দিন পরে আমি চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। একজন প্রশ্ন করতেই পারেন পনেরো বছর আগের সেই ঘটনাগুলো নিয়ে আমি আবার এতদিন পর ব্যস্ত হয়েছি কেন?

তার কারণ ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের সেই একমুখী শিক্ষার মতো আবার মাধ্যমিক শিক্ষায় বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের বিভাজনটি তুলে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পনেরো বছর আগে যে বিষয়টি পরিকল্পনাহীনভাবে পুস্তক ব্যবসায়ীদের নিয়ে করার চেষ্টা করে এই দেশের কোটি কোটি টাকা, অনেক মানুষের শ্রম এবং মেধার অপচয় করা হয়েছিল, সেই ঘটনার যেন আবার পুনরাবৃত্তি না হয় আমি সেই বিষয়টিতে নিশ্চিত হতে চাই।

শিক্ষা সংক্রান্ত কোনও কোনও কমিটিতে আমাকে মাঝে মাঝে ডাকা হয়। তার সব অভিজ্ঞতা যে ভালো সেটা বলা যাবে না। উদাহরণ দেওয়ার জন্য আমি সবসময় শিক্ষানীতির কথা বলি, আমরা মোটেও চারটি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলিনি কিন্তু এখন ছেলেমেয়েদের চারটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। আমরা আট বছর প্রাইমারি শিক্ষার কথা বলেছিলাম, সেটি এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমরা প্রথম তিন বছর শিশুদের কোনও পরীক্ষা না নেওয়ার কথা বলেছিলাম কিন্তু স্কুলগুলোয় একেবারে দুধের বাচ্চাদেরও পরীক্ষা নেওয়া হয়। আমরা ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার কথা বলেছিলাম, গান গাওয়ার কথা বলেছিলাম, ছবি আঁকার কথা বলেছিলাম। কিন্তু তার বদলে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার ওপর তথ্য জানতে হয়, চারু ও কারুকলার তথ্য মুখস্থ করে তার ওপর নিরানন্দ পরীক্ষা দিতে হয়, আনন্দের বদলে এখন তাদের জীবনে নতুন বিড়ম্বনা। অসংখ্যবার সৃজনশীল প্রশ্নের বিশাল ডাটাবেজ তৈরি করে মানসম্মত প্রশ্নের সমস্যার সমাধান করার কথা বলা হয়েছে, কখনও সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়নি। (যদিও যশোর বোর্ড সেটি করে দেখিয়ে উদাহরণ তৈরি করে রেখেছে!) কেউ যেন মনে না করে এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে আমি হতাশা অনুভব করি। আমি মোটেও হতাশ নই। শিক্ষার পেছনে জিডিপি-এর ৬ ভাগ দেওয়ার কথা, আমরা তার তিন ভাগের একভাগ দিয়ে যে লেখাপড়ার আয়োজন করেছি, আমার ধারণা পৃথিবীর কোনও দেশ এত কম টাকা খরচ করে এত ব্যাপক আয়োজন করতে পারবে না! সত্যি কথা বলতে কী, আমি যখনই চিন্তা করি যে এই দেশে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সমানভাবে (এমনকী একটু ভালোভাবে) লেখাপড়া করছে, তখনই আমার মন ভালো হয়ে যায়।

শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে যেসব কমিটি তৈরি করা হয় সেগুলো লক্ষ করে আমি একটা বিষয় আবিষ্কার করেছি। সেটা হচ্ছে, এই কমিটিগুলোতে যে শিক্ষাবিদেরা থাকেন সেখানে বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা মেডিকেলের শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম। কাজেই যখনই শিক্ষাসংক্রান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেখানে বিজ্ঞান শিক্ষা একটুখানি কম গুরুত্ব পায় বলে আমার ধারণা হয়েছে। আলাদাভাবে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ না রেখে যদি সবাইকে একইভাবে পড়ানো হয় তাহলে মানবিক এবং বাণিজ্য শিক্ষায় খুব বেশি পরিবর্তন হবে না কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষায় একটি অনেক বড় মৌলিক পরিবর্তন হবে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আজীবন বিজ্ঞান পড়ে এসেছি বলে এই বিষয়টা অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমি সবসময় লক্ষ করেছি, যে শিক্ষাবিদেরা বিজ্ঞানের মানুষ নন তারা এই বিষয়টা সেভাবে অনুভব করেন না। তারা নানা দেশের উদাহরণ দেন, শিক্ষসংক্রান্ত গভীর জ্ঞানের কথা বলেন, অতীতের উদাহরণ দেন কিন্তু আমাদের দুর্ভাবনাটি অনুভব করতে পারেন না।

তখন আমার শুধু বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হয়। পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মাটিতে পা রাখার সাত মাসের ভিতরে তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিশন তৈরি করেছিলেন। সেই শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব কিন্তু তিনি একজন শিক্ষাবিদকে না দিয়ে একজন বিজ্ঞানী−ড. কুদরাত-এ-খোদাকে দিয়েছিলেন! শিক্ষার ব্যাপারে একজন বিজ্ঞানী কী স্বপ্ন দেখেন, বঙ্গবন্ধুর কাছে সেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ড. কুদরাত-এ-খোদাকে বঙ্গবন্ধু যতটুকু বিশ্বাস করেছিলেন, তিনি তার পুরো মর্যাদা রেখেছিলেন। ৩৬টি অধ্যায়ের ৪৩০ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি তৈরি করার জন্য ড. কুদরাত-এ-খোদা ৯০টি প্রশ্ন দশ হাজার মানুষের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আমরা কি কখনও ড. কুদরাত-এ-খোদার মতো করে চিন্তা  করতে পারি? আমরা সবাই কি ধরে নেই না যে, অন্যের মন্তব্য শোনার কোনও প্রয়োজন নেই, আমি ভাসা ভাসাভাবে যেটা জানি, সেটাই হচ্ছে সারা পৃথিবীর মাঝে একমাত্র গ্রহণযোগ্য একটি সিদ্ধান্ত এবং সেটাকেই অন্যের ওপর চাপিয়ে দেই, মনে করি যেভাবেই হোক সেটাই বাস্তবায়ন করতে হবে।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে শেষবার আমাদের শিক্ষাক্রম রেডি করা হয়েছিল। প্রতি পাঁচ বছর পরপর সেটাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন করার কথা। এই প্রক্রিয়াটি শুরু করা হয়েছে এবং এই শিক্ষাক্রমের আওতায় নানা ধরনের পরিবর্তনের মাঝে একটি হচ্ছে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগকে একীভূত করে ফেলা। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের একমুখী শিক্ষার পরিকল্পনার তুলনায় এটি এর মাঝেই অনেক বেশি বাস্তবমুখী পরিকল্পনা, কারণ সামনের বছর সেটি শুধু ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য কার্যকর করা হবে। ছাত্রছাত্রীরা যখন সপ্তম শ্রেণিতে উঠবে তখন সপ্তম শ্রেণির জন্য সেটি কার্যকর হবে, এভাবে নবম দশম  শ্রেণির শিক্ষাক্রম কার্যকর করার জন্য আমাদের হাতে এক দিন দুই দিন নয়, চার বছর সময় আছে। এই দীর্ঘ সময়টিতে ঠিকভাবে পরিকল্পনা করা যাবে, আলোচনা করা যাবে, বিশ্লেষণ করা যাবে। সাধারণ মানুষের মন্তব্য শোনা যাবে, শিক্ষকদের বক্তব্য নেওয়া যাবে এবং বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তারদের বক্তব্যও শোনা যাবে। দেশের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যদি এই অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি করা হয়, আমার ধারণা এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

নবম দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগে ভাগ না করার জন্য একটা যুক্তি দেওয়া হয় যে, এত অল্প বয়সে তারা কে কোন বিভাগে পড়বে সেটি তখনও বুঝতে শিখে না। এই যুক্তিটির কতখানি সত্যি আমি জানি না−আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। আমি দেখেছি তাদের ভেতরে যারা বুঝতে পারে, পাস করে তীব্র প্রতিযোগিতা করে মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় তারা পড়ার সুযোগ পাবে না, তারা বাণিজ্য কিংবা মানবিক বিভাগে যায়। অন্য সবাই বিজ্ঞান পড়তে চায়, কারণ তারা জানে বিজ্ঞান পড়লে ভবিষ্যতে তাদের সব সুযোগ খোলা থাকে। তবে যে কারণেই হোক আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের ধারণা হয়েছে যে বিজ্ঞান পড়তে হলে তাকে অবশ্যই প্রাইভেট এবং কোচিং করতে হবে, সবার সেই আর্থিক ক্ষমতা থাকে না বলে তাদের অনেকে বিজ্ঞান পড়তে সাহস পায় না। শুধু তা-ই নয়, আমার ধারণা ছাত্রছাত্রীরা একা বিভাগ নির্বাচন করে না, তাদের পরীক্ষার ফল দেখে অভিভাবক এবং শিক্ষকেরা মিলে তার বিভাগ নির্বাচন করে দেন।

তবে নবম দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগে ভাগ করে ফেলার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা বিষয় নিয়ে সারা জীবন দুঃখ করে এসেছি। আমি বড় হয়ে টের পেয়েছি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার জন্য পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বা জীববিজ্ঞানের মতো আমার অন্য একটি বিষয়ে অবশ্যই প্রাথমিক কিছু জ্ঞান থাকার প্রয়োজন ছিল, সেই বিষয়টি হচ্ছে অর্থনীতি। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সেটি কোনোভাবে সম্ভব নয়, বিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্র এই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়টি সম্পর্কে কোনও ধারণা না নিয়ে তার লেখাপড়া শেষ করে। শুধু তা-ই নয়, নবম দশম শ্রেণির পাঠ্যবইগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি আবিষ্কার করেছি, বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা মানবিক বা বাণিজ্য শাখার বিজ্ঞান বইয়ের প্রজনন সংক্রান্ত অসাধারণ একটি অধ্যায় থেকে বঞ্চিত হয়। (শুনেছি স্কুলের শিক্ষকেরা নাকি ক্লাসে এই বিষয়টা পড়াতে সংকোচবোধ করেন, তাই তারা সেটা পড়ান না এবং ছেলেমেয়েরা নিজেরা পড়ে নেয়!)। শুধু তা-ই নয়, তারা যদি জীববিজ্ঞান বিষয়টি না নেয় তাহলে তারা বিবর্তনের মতো বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানার কোনও সুযোগ পায় না। কাজেই এখন শিক্ষাক্রম সুন্দর করে সাজিয়ে একটা ছেলে বা মেয়েকে একদিকে প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান, অন্যদিকে অর্থনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখানোটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমি যেহেতু দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে এসেছি, তাই মোটামুটিভাবে মাধ্যমিক পাস করে আসা বিজ্ঞান বিভাগের ছেলেমেয়েরা কতটুকু জানে সেটা বলতে পারি। আমার বলতে দ্বিধা নেই আমি আরও বেশি খুশি হতাম যদি তাদের প্রস্তুতিটি আরেকটু ভালো হতো। কাজেই যদি বিজ্ঞান বিভাগের বিভাজনটি উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময়েই করা হয় তাহলে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান এবং গণিত শেখার সময় প্রায় অর্ধেক হয়ে যাবে। আশঙ্কা আছে, তাদের যেটুকে শেখার কথা সেটুকু শিখবে না। কাজেই অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু শেখানোর জন্য খুবই যত্ন করে শিক্ষাক্রমটি দাঁড়া করতে হবে। আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যেন উচ্চমাধ্যমিক পড়া শেষ করার পর তাদের প্রস্তুতিটি কোনোভাবেই আগের থেকে কম না হয়। যদি নতুন শিক্ষাক্রম দিয়ে আমরা আগের থেকে দুর্বল শিক্ষার্থী তৈরি করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠাই তাহলে সেটা মেনে নেয়া খুব কঠিন।

আমরা সবাই জানি আমাদের লেখাপড়ার বিষয়টিতে এখনও নানা ধরনের সমস্যা আছে। দেশের সবাইকে নিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করতে হবে, আমরা যেন কখনোই কয়েকজন বেশি আত্মবিশ্বাসী মানুষের সিদ্ধান্ত দিয়ে একটি বড় পরিবর্তনে হাত না দেই! বঙ্গবন্ধু যাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেই ড. কুদরাত-এ-খোদাও কিন্তু তার কমিটির কিছু মানুষকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেননি। সেই ইন্টারনেট-ইমেইলবিহীন সময়েও তিনি দশ হাজার মানুষের মন্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

এখন তাহলে আমরা কেন অল্পে সন্তুষ্ট হবো? 

লেখক: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033280849456787