শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের চেষ্টা এবারও পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। স্বায়ত্তশাসন খর্বের দোহাই দিয়ে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। শুক্রবার (৫ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মুসতাক আহমদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অথচ রাষ্ট্রপতির নির্দেশনার পর এক বছর ধরে এ নিয়ে জোরালো আলোচনা চলছিল। তবে এবার কৃষি ও কৃষির প্রাধান্য থাকা আট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একইদিনে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিতে সম্মত হয়েছে।
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা প্রবর্তনের লক্ষ্যে একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটির সদস্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, এ বছর কৃষি ও কৃষির প্রাধান্য থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে একটিমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গুচ্ছবদ্ধ করে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করতে পারলে ভালো হতো। এ নিয়ে আলোচনাও চলছে। তবে বিষয়টা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের দেশের নানা প্রান্তে দৌড়াতে হয়। এতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা শারীরিক-মানসিকভাবে ভোগান্তিতে পড়েন। এছাড়া প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক গবেষণাও উঠে এসেছে।
গবেষণায় বলা হয়, প্রতি ভর্তি মৌসুমে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়া, ভর্তি কোচিংসহ আনুষঙ্গিক খাতে একজন শিক্ষার্থীর গড়ে ৯৬ হাজার টাকা খরচ হয়। অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর পক্ষে এ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না। সংশ্লিষ্টরা জানান, এমন বাস্তবতার কারণেই মেডিকেল কলেজের আদলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভিত্তিক সমন্বিত পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনে উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরোধিতার কারণে সম্ভব হচ্ছিল না। এবারও সেই একই ঘটনা ঘটল।
এ ব্যাপারে ১০ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি বলেছিলেন, কিছু বড় বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে এর (সমন্বিত ভর্তি) বিরোধিতা করছে। কিন্তু সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের জন্য খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, এতে হয়রানি ও অর্থ অপচয় অনেক কমে যাবে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে এখানে-ওখানে গিয়ে পরীক্ষা দেয়া কষ্টকর। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, অনেক সময় ছেলেরা মসজিদে ঘুমিয়ে পরীক্ষা দেয়। কিন্তু মেয়েরা কোথায় গিয়ে থাকবে?
তিনি বলেন, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা সমন্বিত করতে পারলে অন্য ভর্তি পরীক্ষা সমন্বিত করতে কেন পারব না? সবার একটু সদিচ্ছা থাকলে নিশ্চয়ই করা সম্ভব। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহযোগিতা করবে।
গত বছর ১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে বৈঠককালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ গুচ্ছ ভর্তির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু সময় স্বল্পতার অজুহাতে গত বছর তা চালু করা হয়নি। এ ব্যাপারে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের পাশাপাশি পদক্ষেপ নিতে এখন পর্যন্ত একাধিকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) চিঠি দেয়া হয়। ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের এ উদ্যোগ নেয়া হয়
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব ইউজিসি পরিচালক কামাল হোসেন বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, অগ্রগতি কিছুটা তো হয়েছে। আলোচনার অগ্রগতিতে মনে হচ্ছে এবার কৃষি ও কৃষির প্রাধান্য থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই প্রশ্নে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। বাকিগুলোতে হয়তো এবারও সম্ভব হবে না। আগামীতে বাকিরা এগিয়ে আসবে বলে কমিটির সদস্যরা মনে করেন।
প্রথমবারের মতো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে সম্মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি বিভাগে মেধা ও পছন্দভিত্তিক শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হবে।
ভর্তি ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী কোন কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দেবেন, তাও তাদের পছন্দের ভিত্তিতে ঠিক করা হবে। এখন কোন প্রক্রিয়ায় ভর্তির আবেদন নেয়া হবে, ফি কত টাকা হবে ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমবারের এ ভর্তি প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেবে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পরের বছরগুলোতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্বে থাকবে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, তবে সীমিত পরিসরে এ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের ফলে কৃষি বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহীদের জন্য অনেকটাই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনে স্বায়ত্তশাসন খর্বের কথাটি অজুহাত মাত্র। এখানে আর্থিক দিকটিই মুখ্য।
যুগান্তরের অনুসন্ধানেও বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। ভর্তি পরীক্ষার ফি বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি বছর বহু টাকা আয় করে। এর পরিমাণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত। ভর্তি পরীক্ষা থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেয়ার কথা থাকলেও এ নিয়ে অনীহা আছে। ফলে আয়ের বেশির ভাগই নানা কাজের সম্মানীর নামে ভাগবাটোয়ারা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থেকে শুরু করে পিয়ন-দারোয়ান পর্যন্ত ওই টাকার অংশ পেয়ে থাকেন।
অবশ্য এ ব্যাপারে দ্বিমতও আছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যুগান্তরকে বলেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জটিলতা ও গোপনীয়তা, মাইগ্রেশন পদ্ধতি কিভাবে থাকবে সেগুলো বিবেচনায় আনার জন্য প্রথমত একটি স্বচ্ছ নীতিমালা প্রয়োজন। এটিই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে কাজটি করা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে হয়তো সমন্বিত পদ্ধতির পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তি করা সম্ভব হতে পারে।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালুর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সম্প্রতি এ ব্যাপারে তিনি যুগান্তরকে বলেন, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা ক্যারেক্টার (বৈশিষ্ট্য) আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা গ্রুপে ভাগ করে আলোচনা করেছি। চাইলে হয়তো গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা গত বছরই আয়োজনের সুপারিশ করতে পারতাম। কিন্তু কাজটি তাড়াহুড়োর নয়। কেননা, সামান্য ভুলে বড় বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। এজন্য সময় নিয়ে এ সংক্রান্ত কৌশলপত্র তৈরি করা হচ্ছে।
গুচ্ছ ভর্তি নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। সম্প্রতি যুগান্তরকে তিনি বলেন, আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে বলেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে পরীক্ষা নিচ্ছে। আগামীতে বাকিগুলোও এ প্রক্রিয়ায় আসবে বলে আশা করছি।