শিরোনামের বিষয়ে আলোকপাত করার আগে অন্য একটি কারণে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। বৈশ্বিক মহামারি করোনার দুঃসময়ে নন এমপিও শিক্ষকদের প্রণোদনা বরাদ্দ দিয়ে সরকার গোটা শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য অসাধারণ আন্তরিকতা দেখিয়েছে। বিশেষ একটি সম্মাননা জানিয়েছে। শিক্ষাবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ খাতে সাড়ে ৪৬ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা বরাদ্দ দিয়ে এই বার্তাটি দিতে চেয়েছেন- কেউ না থাকলেও বেসরকারি শিক্ষকদের সুদিন-দূর্দিনে অন্তত একজন পাশে আছেন। তিনি আমাদের জাতির জনকের তনয়া, মানবতার জননী, আপামর জনতার কাছে জননেত্রী-খ্যাত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব রাজনীতিতে এখন তাঁর দাপুটে অবস্থান। করোনা মোকাবেলায় তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ আজ সর্বত্র প্রশংসিত। একমাত্র তাঁর কারণেই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ সব স্কুল-কলেজ এক সাথে সরকারিকরণের স্বপ্নটি দেখে আসছেন ।
এই স্বপ্নটি বুকে ধারণ করে কেউ ন্যূনতম বেতন পেয়ে আর কেউ এক টাকা বেতন না পেয়েও শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে বছরের পর বছর জাতি গঠনের মতো কঠিন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বেতন কিংবা এমপিও না পেয়ে বছরের পর বছর পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটানো কয়েক হাজার অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকের খবর আমরা কয়জনে রাখি? আজ তাদের নিয়ে সামান্য কিছু লিখতে বসেছি। তার আগে নন এমপিও শিক্ষকদের প্রণোদনার টাকা দেবার প্রক্রিয়ার বিষয়ে আরো দু'চারটি কথা বলতে চাই।
অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা নানা কারণে পাঠ দানের অনুমতি পায়নি। আবার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমুহে এমন অনেক শিক্ষক-কর্মচারী আছেন, যারা নানা কারণে ব্যানবেইসের তালিকায় নেই। এ জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারীগণ প্রণোদনার আওতায় আসতে না পারায় এই দূর্দিনে কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন ছিলো। আরেকটি বিষয় এই - যাদের প্রণোদনা দেবার জন্য নির্বাচিত করা হলো তাদের বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি মোবাইল ব্যাংকিয়ের নম্বর চাওয়া হয়।
এখন অন্য কথা শোনা যাচ্ছে। তাহলে মোবাইল একাউন্ট করার কী প্রয়োজন ছিলো ? সর্বশেষ স্ব স্ব ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে চেক দেবার নাকি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমন কথাই শুনলাম দৈনিক শিক্ষার লাইভে। সবার তো আর ব্যাংক একাউন্ট নেই। বিশেষ করে অনেক কর্মচারীর তা নেই। যাদের নেই, তাদের নতুন করে একাউন্ট খুলতে প্রণোদনার অর্ধেক টাকা শেষ হয়ে যাবে। এর অর্থ বুঝে উঠা কঠিন কাজ। এবার অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের কথায় আসি।
অনার্স-মাস্টার্স চালু আছে এমন সব বেসরকারি কলেজের উল্লিখিত কোর্সসমুহে বিধি মোতাবেক নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের সরকারি বেতন নেই। কলেজ পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষকদের অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অনুপাত প্রথা ও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের বেতন না থাকা সত্যি দু'টি দুঃখজনক বিষয়। অনুপাত প্রথাটি নিঃসন্দেহে একটি কালো আইন। এই কালো প্রথাটি কেন জানি আমার কাছে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো অমানবিক মনে হয়। এই প্রথাটি যারা চালু করেছে, তারা খুনী মুশতাকের দোসর ছাড়া কিছু নয়। কলেজের শিক্ষকগণ কেন এটির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলছেন না, সেটি বোধগম্য নহে। কলেজ শিক্ষকদের নেতার অভাব নেই। কিন্তু, জায়গা মতো দাবি তুলে ধরার মতো নেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইদানিং উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তিতে কলেজের প্রভাষকগণ আরেকটি বৈষম্যের শিকার হতে চলেছেন। তাদের প্রারম্ভিক বেতন স্কেলটি ১০ বছর পর একটি উচ্চতর গ্রেড নিয়ে মাত্র ১০০০ টাকা বৃদ্ধি পায়। একজন প্রভাষকের জন্য সত্যি এটি দুঃখজনক এবং যুগপৎ অপমানের বিষয়ও বটে।
অনার্স-মাস্টার্স কোর্সেের জন্য বিধি মোতাবেক নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকগণ বছরের পর বছর বিনা বেতনে জাতি গড়ার মহান ব্রত নিয়ে পরিবার পরিজনসহ কীভাবে বেঁচে আছেন-সেটিই আজ প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেসরকারি বেশ কিছু কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু হয় এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়।এ পর্যন্ত সারা দেশে সাড়ে তিনশ'র মতো বেসরকারি কলেজে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক কর্মরত আছেন। এসব শিক্ষক প্রচলিত সরকারি বিধি মোতাবেক নিয়োগ লাভ করেছেন। বিধির অন্তর্গত সকল দায় দায়িত্ব তারা পালন করে থাকেন। একই প্রতিষ্ঠানে সমান দায়িত্ব পালন করে কেউ বেতন পান, আর কেউ পান না- সেটি সত্যি দুঃখজনক। অনার্স-মাস্টার্সের সব শিক্ষকই উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি তাদের রয়েছে। অনেকে পিএইচডি করা। তাদের অনেকের শিক্ষা ও পেশাগত ব্যাকগ্রাউণ্ড অনেক ভালো। কিন্তু তাদের এমপিও কিংবা সরকারি বেতন না থাকায় তারা সব সময় হীনমন্য জটিলতায় ভোগে থাকেন। পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করেন। কত বার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা প্রণীত হলো ? খসড়া নীতিমালা হলো। এর সংশোধন হলো। চুড়ান্ত নীতিমালা হলো।
কিন্তু, কেউ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের দিকে একবারও ফিরে চাইলো না। কী অমানবিক কায়-কারবার? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মাউশি কী এসব শিক্ষকদের বিষয়ে তাদের দায় এড়াতে পারে ? যারা উচ্চ শিক্ষার মশাল হাতে নিয়ে নিত্য বয়ে বেড়ান, তিলে তিলে নিজের জীবন-যৌবন ক্ষয় করে জাতি বিনির্মাণের শেষ কাজটি সমাধা করেন-তাদের সর্বশেষ জনবল কাঠামো ২০১৮ তে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই যৌক্তিক ছিলো। উল্লেখিত জনবল কাঠামোটি সংশোধনীর পর্যায়ে আছে বলে জানি। সংশোধনী কমিটি যেন তাদের জনবল কাঠামোর অন্তর্গত করতে সরকারের কাছে জোর সুপারিশ করে-সেই অনুরোধটুকু জোরেশোরে করতে চাই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয়কে এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে দু'কলম লিখে দেবার সবিনয় অনুরোধ করি। মাননীয় ভিসি মহোদয়, ভুক্তভোগী অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা আপনারই স্বজন। তাদের মুখে হাসি ফুটানো আমাদের সবার দায়িত্ব।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার সংবাদ বিশ্লেষক।