প্রতিষ্ঠান সর্ম্পকে সরেজমিনে খোঁজখবর না নিয়ে এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশের পর যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করায় ‘হ-য-ব-র-ল’ অবস্থায় পরেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একদিকে আমলাদের তৈরি ‘কথিত’ নীতিমালার ভিত্তিতে এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশ করায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করছেন সংসদ সদস্য (এমপি) ও জনপ্রতিনিধিরা। অপরদিকে শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে তালিকাভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে ঢাকায় ঢেকে পাঠানোয় তারাও অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। কারণ সব স্কুলেই এখন বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। এ কাজ ফেলে রেখে তাদের ঢাকায় হাজির হতে হচ্ছে। রোববার (৮ ডিসেম্বর) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় বসে এমপিওভুক্তির তালিকা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ঢেকে পাঠিয়ে তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হচ্ছে। সময়স্বল্পতার কারণে সরেজমিনে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন সম্ভব হচ্ছে না। এতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এমপিও পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকার সুযোগও থাকছে। পুরো তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কারণে এমপিওভুক্তির তালিকা কার্যকর করতেও বিলম্ব হতে পারে। আবার তালিকাভুক্ত কোন প্রতিষ্ঠান বাদ পড়লে তারাও আইনের আশ্রয় নিতে পারে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে এমপিওভুক্তির তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদ পরেছিল, পরবর্তী সময়ে আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্তি পায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র (নজরুল) সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘যাচাই-বাছাই না করে এমপিওভুক্তি করা হলো কেন? এমপিওভুক্তির গেজেট প্রকাশ করে এখন যাচাই-বাছাইয়ের নামে শিক্ষকদের হয়রানি করা হচ্ছে; টাকা-পয়সা নেয়া হচ্ছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। আজ এই তথ্য, কাল ওই তথ্য চাওয়া হচ্ছে শিক্ষকদের কাছে। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর অর্জনকে নষ্ট করা হচ্ছে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি আমলারা এমপিওভুক্তির কার্যক্রমকে বিতর্কিত করেছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তালিকা চূড়ান্ত করার আগে শিক্ষক সংগঠনগুলোর সহযোগিতা নেয়া যেতো। আর এ কাজটি তো মাউশি’র। মাউশি’কে কেন বাদ রাখা হয়েছিল-বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিৎ।’
গত ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত শিক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এবারের এমপিওভুক্তি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া ভুয়া প্রতিষ্ঠান বাদ দেয়া ও যোগ্য প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য সম্প্রতি এমপিরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৩ অক্টোবর দুই হাজার ৭৩০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশ করে, যার মধ্যে মাদরাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৭৬টি। এই তালিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন মহলে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ তালিকায় স্থান পায় প্রায় অস্থিত্বহীন ও যুদ্ধাপরাধীর নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, জাতীয়করণ হওয়া প্রতিষ্ঠান, আংশিক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান, স্বীকৃতিবিহীন এবং ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ও ট্রাস্ট পরিচালিত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।
আবার অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করা হয়েছে, যেগুলোতে এনটিআরসিএ সনদধারী কোন শিক্ষকই নেই। শিক্ষক না থাকলে ওইসব প্রতিষ্ঠানে আদৌ কোনো শিক্ষার্থী রয়েছে কি না, নাকি ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে এমপিওভুক্তি করা হয়েছে- তা নিয়েও বিতর্ক চলছে। খোদ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
এমপিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বেতনভাতা ছাড় করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এমপিওভুক্তি ও নন-এমপিওসহ যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ তদারকও করে মাউশি। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে এক হাজার ৬২৪টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তালিকাও তৈরি হয়েছিল এই সংস্থার অধীনে। এতে বিতর্কিত ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান ও অস্থিত্বহীন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তালিকায় স্থান পায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের এমপিওভুক্তির তালিকা তৈরির সময় মাউশিকে একেবারে অন্ধকারে রাখা হয়। মাউশি’র কোনো কর্মকতাকেই এ কাজে সম্পৃক্ত করা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা নিজেদের তৈরি করা ‘কথিত’ নীতিমালার দোহাই দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তালিকা তৈরি করেছেন। এ নিয়ে নানা অভিযোগও পাওয়া গেছে। এক পর্যায়ে এমপিওভুক্তির তালিকা তৈরির দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদকে সরিয়ে দেয়া হয়; যাতে নাখোশ হয় মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা, যার গাফিলতির কারণে এ কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা হয়েছে।
এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশের পর তীব্র সমালোচনার মুখে পুরো তালিকা যাচাই বাছাইয়ের জন্য গত ১৩ নভেম্বর একটি কমিটি এবং ১৪ নভেম্বর আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৬৫০টি স্কুল ও কলেজের তথ্য যাচাই বাছাইয়ের জন্য মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের নেতৃত্বে সাত সদস্যদের একটি কমিটিকে ২০ কর্মদিবসের মধ্যে এমপিওভুক্তির তালিকার সঠিকতা যাচাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে মাউশি উপপরিচালক (মাধ্যমিক) এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধিকেও রাখা হয়েছে কমিটিতে।
স্কুল ও কলেজের তথ্য যাচাই কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। গত ৪ ডিসেম্বর থেকে এ কমিটি তালিকাভুক্ত সবকটি স্কুল ও কলেজের প্রধানকে পর্যায়ক্রমে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে তথ্য-প্রমাণ নিয়ে হাজির হতে বলেছে। আগামী ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান প্রধানদের হাজির হতে হবে।
এ কমিটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যই যাচাই করা হচ্ছে। এর বাইরে সব প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই সম্ভব হবে না। সময় কম। এরপরও কিছু প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে, যেগুলোর স্বীকৃতি নেই বা ৫-৭ বছর ধরে স্বীকৃতি নবায়ন হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে এমপিওভুক্ত হলো সেটা চিন্তার বিষয়।’
এদিকে নতুন এমপিওভুক্ত হওয়া এক হাজার ৭৬টি মাদরাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কলেজের তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু হবে আগামী ১৮ ডিসেম্বর। চলবে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এমপিওভুক্তির তালিকায় স্থান পাওয়া মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি এ সিন্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি সদ্য এমপিওভুক্ত মাদরাসার তথ্য যাচাইয়ে ২টি ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাইয়ে ২টিসহ মোট ৪টি সাব-কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
গত ১৪ নভেম্বর নতুন এমপিওভুক্ত হওয়া মাদরাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কলেজগুলোর তথ্য যাচাই-বাছাই করতে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) রওনক মাহমুদকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচিত এক হাজার ৭৬টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাইয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর ও বোর্ড, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও বোর্ড এবং ব্যানবেইসের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে চারটি সাব-কমিটি গঠন করা হবে। তারা তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট পাঁচ দিন নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে।
তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সময়সূচি কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর ও বোর্ড, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও বোর্ড, জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেয়া হবে। কমিটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই করে এমপিওভুক্তির যথার্থতা নিরুপণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যানবেইসের (শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো) সফটওয়্যারের মাধ্যমে সরবরাহ করা তথ্যের যেসব প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিওর তালিকা প্রকাশ করেছে সেগুলোও যাচাই করে দেখা হবে। কারণ ব্যানবেইস পুরনো তথ্যের ওপর কাজ করে। তাদের কাছে সর্বশেষ তথ্য নেই।
নতুন এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দাখিল মাদরাসা সংখ্যা ৩৫৮টি, আলিম মাদ্রাসার সংখ্যা ১২৮টি, ফাযিল মাদরাসা ৪২টি ও কামিল মাদরাসা ২৯টি, কৃষি ৬২টি, ভোকেশনাল স্বতন্ত্র ৪৮টি, ভোকেশনাল সংযুক্ত ১২৯টি, বিএম স্বতন্ত্র ১৭৫টি ও বিএম সংযুক্ত ১০৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
জানা গেছে, এমপিওভুক্তির জন্য গত বছরের আগস্টে আবেদন করে নয় হাজার ৬১৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে দুই হাজার ৭৩০টি প্রতিষ্ঠানকে ২৩ অক্টোবর এমপিওভুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়। এরমধ্যে ২০৪টি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দেয়া হয়। তালিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, বঞ্চিত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে।
‘কথিত’ নীতিমালা অনুযায়ী চার শর্ত পূরণকারী প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দেয়া হয়েছে। শর্তগুলো হলো- প্রতিষ্ঠানের বয়স বা স্বীকৃতির মেয়াদ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার। প্রতিটি পয়েণ্টে ২৫ করে নম্বর থাকে। কাম্য শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং স্বীকৃতির বয়স পূরণ করলে শতভাগ নম্বর দেয়া হয়। সর্বনিম্ন ৭০ নম্বর পাওয়া প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির জন্য বিবেচিত হয়।