অনিবন্ধিত বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নিবন্ধনপ্রাপ্তির দাবির মুখে সরকার তড়িঘড়ি করে 'বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮' জারি করেছে। এর মাধ্যমে আন্দোলনকারী শিক্ষক ও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত হওয়ার রাস্তা প্রসারিত হলো। প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে এ লেখায় আলোকপাত করা হলো।
১. নীতিমালায় এমপিওপ্রত্যাশী বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ক. নিম্নমাধ্যমিক (ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণি); খ. মাধ্যমিক (ষষ্ঠ-দশম শ্রেণি); গ. উচ্চমাধ্যমিক (ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণি); ঘ. উচ্চমাধ্যমিক কলেজ (এগারোতম-দ্বাদশতম শ্রেণি) ও ঙ. স্নাতক পাস কলেজ (এগারোতম-পনেরোতম)। এই পাঁচটি ক্যাটাগরির প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা জনবল কাঠামোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের জন্য ৩০ জন জনবলের উলেল্গখ থাকলেও প্রজ্ঞাপনে উলিল্গখিত পদবির বিপরীতে দেওয়া পদসংখ্যা আলাদাভাবে যোগ করলে যোগফল হয় ২৯। এ ধরনের ভুলের জন্য কাউকে না কাউকে মাশুল দিতে হতে পারে। যেমন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যদি ৩০তম কাউকে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে চাকরিপ্রত্যাশী ব্যক্তির পরবর্তী ভোগান্তির দায় কে নেবে- প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নাকি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি? আবার ঐচ্ছিক বিষয়ের প্রভাষক, প্রদর্শক, ল্যাব সহকারী পদে প্রতি বিষয়ের জন্য একজন করে নিয়োগ দেওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে আদেশে উলিল্গখিত মোট পদসংখ্যার বেশি হয়ে যাবে। জনবল কাঠামোতে উলিল্গখিত মোট পদসংখ্যার বেশি নিয়োগ দেওয়া কি সম্ভব? বিষয়টির পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা থাকলে ভালো হতো।
২. আবার নিয়োগ এমনভাবে হতে হবে, যেন একজন শিক্ষক তার মূল বিষয়ের বাইরেও নূ্যনতম অপর দুটি বিষয়ে ক্লাস নিতে পারেন। কিন্তু উলেল্গখ নেই যে, অপর দুটি বিষয় বলতে কোন দুটি বিষয়কে বুঝানো হবে। কারণ এই বিষয়টি একটি অসৎ কাজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। যেমন গণিত শিক্ষক নিয়োগের সময় নিয়োগ বোর্ডের প্রভাব বিস্তারকারী কেউ একজন সামাজিক বিজ্ঞান বা গার্হস্থ্য জ্ঞানের অভাব দেখিয়ে ভালো মানের একজন গণিত শিক্ষককেও বাদ দিয়ে দিতে পারবেন।
৩. নীতিমালায় আছে, যে কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন করে দ্বিতীয় শিফট খুলতে পারবে না। এর মানে কিন্তু এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় যে, যেসব প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় বা তার বেশি শিফট চালু আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনে পরবর্তী শিফট খোলা যাবে। কেননা এর কোনোটিই আর দ্বিতীয় শিফট নামে হবে না।
৪. চলমান এমপিওভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে একজন প্রার্থীকে ইনডেক্সধারী বা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হয়। অথচ নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের সময় একজন শিক্ষকের কোনোটি না থাকলেও শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পূরণ করলেই এমপিওভুক্ত হতে পারবেন। এমনকি প্রধান শিক্ষক বা সহকারী প্রধান শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতার আংশিক অভাব থাকলেও পদে থেকেই পরবর্তীকালে তা অর্জন করার সুযোগ পাবেন। নীতিমালায় এ ধরনের ব্যবস্থা রাখা যথাযথ হয়েছে বলে মনে হয়নি।
৫. নীতিমালার ১১.৩-এ বলা আছে যে, একজন স্কুলের শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্তির পাঁচ বছরের মধ্যে শিক্ষায় ডিগ্রি (যেমন- বিএড-ডিপ-ইন-অ্যাড-সমমান) অর্জন করলে তিনি গ্রেড-১০-এ বেতন পাবেন। এর নানা তাৎপর্য হতে পারে। যেমন পাঁচ বছর পর এসব ডিগ্রি করলেও তিনি গ্রেড-১০-এ উন্নীত হতে পারবেন না। আবার পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সম্পন্ন করলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেড-১০-এ বেতন পাবেন নাকি পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে গ্রেড-১০-এ বেতন পাবেন না, তা স্পষ্ট নয়।
৬. ধারা ১১.৮-এ উলেল্গখ আছে যে, ইনডেক্সধারী শিক্ষক-কর্মচারী এক ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য ধরনের প্রতিষ্ঠানে সমপদে-সমস্কেলে যোগদান করলে পূর্ব অভিজ্ঞতা গণনাযোগ্য হবে। কিন্তু কেউ যদি উচ্চতর পদে যেমন সহকারী শিক্ষক থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক থেকে উপাধ্যক্ষ পদে অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান, তাহলে তার আগের অভিজ্ঞতা কি গণনাযোগ্য হবে না? যদি না হয় তাহলে পরবর্তী উচ্চতর পদে যাওয়ার সুযোগ এলেও তার প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার স্বল্পতা দেখা দিতে পারে।
৭. পূর্বের নিয়মে বেসরকারি স্কুল-কলেজের চাকরিতে বদলির সুযোগ ছিল না। বর্তমান নিয়মে বদলির সুযোগ রাখা হয়েছে। এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। তবে বলা হয়েছে যে, সরকার চাইলে নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এ ধরনের বদলি করতে পারে। এখানে দুটি জটিল বিষয় উলেল্গখ করা হলো। প্রথমত, সরকার বলতে কী বুঝানো হয়েছে তা পরিস্কার নয়। যেমন- এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসাপেক্ষে বদলি করতে হবে, নাকি শিক্ষা বিভাগের উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক অনুমোদন নিয়ে বদলি হবে, তা প্রাথমিকভাবে বোঝা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, নীতিমালা প্রণয়ন কীভাবে হবে, কারা করবেন, নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য কারা হবেন বা কত দিনের মধ্যে করতে হবে, তার দিকনির্দেশনা নেই। কাজেই হবে, হয়ে যাচ্ছে করে এমন বড় একটি উদ্যোগ যেন থেমে না থাকে।
৮. ধারা ২০-এ উলেল্গখ আছে যে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের তার প্রতিষ্ঠান বার্ষিক মূল্যায়ন করবে। শুধু প্রতিষ্ঠান শব্দটি লিখে মূল্যায়নকারী কর্তৃপক্ষকে স্পষ্ট করা হয়নি। কারণ প্রতিষ্ঠানে কে করবেন এই কাজ- প্রধান শিক্ষক-অধ্যক্ষ, ব্যবস্থাপনা কমিটি নাকি সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা?
৯. একই ভৌগোলিক দূরত্বে একাধিক সমপর্যায়ের প্রতিষ্ঠান থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করে এক নামে এবং এক প্রশাসনের অধীনে পরিচালনা করার পরামর্শ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। অবকাঠামোগুলো একই প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পাস হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এ ধরনের প্রস্তাবে তিনটি সমস্যা আছে। প্রথমত, ক্যাম্পাসগুলোতে যে প্রাক্তন হেড ছিল, তার পরবর্তী পদবি বা কর্মব্যাপ্তি কী হবে? দ্বিতীয়ত, মূল নীতিমালায় উলেল্গখ আছে যে কোনো দ্বিতীয় ক্যাম্পাস খোলা যাবে না। তাহলে অর্থ বিভাগের সুপারিশ কি মূল নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? তৃতীয়ত, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি পাড়া, গ্রাম, মহলল্গা বা এলাকার ঐতিহ্যগতভাবে যোগসাজশ তৈরি হয়। এ ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে কি সেসব এলাকার জনগণ একমত হবে? বরঞ্চ আমার মনে হয় যে, কোনো কোনো এলাকায় তা সংঘর্ষের রূপ নিতে পারে।
১০. প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি হওয়ার আবেদনের পর প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের লক্ষ্যে ধারা ১৬ মোতাবেক গঠিত কমিটি দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করবে। বিষয় দুটি হলো- সূচকভিত্তিক গ্রেডিং ও জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। সূচকভিত্তিক গ্রেডিং নির্ণয় করার জন্য চারটি প্যারামিটার রয়েছে। প্রতিটির জন্য সূচক মান হবে ২৫। সরকার একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে তা করবে। বিষয়টিতে স্বচ্ছতা থাকবে। দ্বিতীয়টি অর্থাৎ জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক একটি ব্যাপার। যে কোনোটি জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ধারণ হবে টাকা আর পেশিশক্তি দিয়ে।
তবে সার্বিকভাবে নীতিমালা উন্নয়নের মাধ্যমে সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা প্রশংসনীয়। আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, যথাযথভাবে এবং দ্রুত সময়ে শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা হবে। তাদের এমপিওভুক্ত করার পাশাপাশি জাতি শিক্ষকদের কাছে এটাও আশা করে যে, তারা পূর্ণ শ্রমে ও মনোযোগে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের ছাত্রদের পাঠদান ও শিক্ষা দেবেন।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ
সৌজন্যে: সমকাল