এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রির দোকানে উপচেপড়া ভীড়!

বদরুল আলম শাওন |

তথাকথিত কিছু কাগজ জমা দেয়ার পর একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ আর মুঠোভর্তি টাকা দিলেই মিলছে  এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি থেকে শুরু করে যেকোনো বিষয়ে গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট!

মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নাকের ডগায় এমন সনদবিক্রির দোকানে বছরের পর বছর রমরমা বেচাকেনা চললেও শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই। পত্র-পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর শুধু দোকানগুলোর ঠিকানা পরিবর্তন হয়।

দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর বনশ্রীতে সনদ বিক্রির এ রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল কালচার ইউনিভার্সিটি (ভার্চুয়াল অ্যান্ড রিসার্চ)’। শর্টকার্টে যারা বড় বড় ডিগ্রি চান মূলত তারা এর ক্রেতা। ক্রেতাদের ধাঁধায় ফেলতে এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহার করছে বাংলাদেশ সরকারের লোগো; কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের আগে ‘প্রস্তাবিত’ শব্দটিও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। চার বছর আগে এ প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত ছিলো্। দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর ঠিকানা পরিবর্তন করে বনশ্রীতে আসে। বর্তমানে বনশ্রীর এ ব্লকের এসএস-১ নম্বর সড়কের ১/৮ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় ইন্টারন্যাশনাল কালচার ইউনিভার্সিটি অবস্থিত।

যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি) এ প্রতিষ্ঠানটির তদন্ত শেষে প্রতিবেদনটি ৭ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। যথারীতি এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন  বলেন, প্রতিষ্ঠানটি যত লোগোই ব্যবহার করুক না কেন, তাদের কার্যক্রম পুরোটাই ভুয়া। পিএইচডি কখনও অনলাইনে করা যায় না। ক্লাস, পরীক্ষা আর গবেষণা ছাড়া কোনো ধরনের শিক্ষা হতেই পারে না।

জানা যায়, সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে, প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে যেসব পিএইচডি, এমফিল, মাস্টার্স ও ব্যাচেলর ডিগ্রি দিচ্ছে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ছাড়া তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহার করছে। তাদের এ ধরনের প্রতারণার ফলে ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা দেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, ‘অবৈধ ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি টাকার বিনিময়ে উচ্চশিক্ষার সনদ বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকাসহ বড় বড় কয়েকটি শহরে তথাকথিত কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডিসহ ভুয়া বিভিন্ন ডিগ্রি বিক্রি করছে। সরকারি অনুমোদন না থাকায় তারা আমাদের অধীনে নয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’

ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন দৈনিকশিক্ষাকে  বলেন, “প্রতিবেদনটি হাতে পাইনি। বৈধ বা অবৈধ যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই সনদ বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ইউজিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল কালচার ইউনিভার্সিটির সরকারি কোনো অনুমোদন নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইনগত ভিত্তি জানতে চাইলে ইউজিসিতে বেশ কিছু কাগজপত্র জমা দেন প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারীরা। তাতে দেখা যায়, ব্যবসা করতে তাদের জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্মস বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সনদ, প্যাটেন্ট ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক কর্তৃপক্ষের সনদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক উচ্চশিক্ষার কনসালট্যান্সি ব্যবসা করার সনদ, অস্ট্রেলিয়ার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন অ্যান্ড রিকগনিশন কাউন্সিল, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড অ্যাক্রিডিটেশন ও বলসব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্বীকৃতি সনদ রয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেবে সরকার। সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের আইন অনুসারে নির্ধারিত ফরমেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আবেদন করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে সরকার প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে থাকে। অনুমোদন পাওয়ার পর প্রোগ্রাম, ডিগ্রি ও কারিকুলাম সংক্রান্ত পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য ইউজিসিতে জমা দিতে হয়। যাচাই-বাছাই, বিশেষজ্ঞ মতামতসহ সন্তোষজনক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইউজিসি অনুমোদন দেওয়ার পরই শুধু প্রোগ্রাম চালু করা যায়। ইন্টারন্যাশনাল কালচার ইউনিভার্সিটি এসবের কোনো কিছুই মানেনি।

পিএইচডি ডিগ্রি বিক্রির পদ্ধতি : জানা যায়, পিএইচডি ডিগ্রি নিতে হলে প্রথমে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে। ভর্তির সময় কিছু শিক্ষা উপকরণ দিয়ে দেওয়া হবে। তার ওপর একটি প্রেজেন্টেশন তৈরি করে এক মাস পরে সেমিনারে অংশ নিতে হবে। এভাবে ২৪ মাসে ২৪টি সেমিনারে অংশগ্রহণ ও প্রতি মাসে সাড়ে দশ হাজার টাকা করে দিলেই মিলবে পিএইচডি ডিগ্রি। তবে কেউ ভর্তি হতে গেলে প্রথমেই বলে দেওয়া হয়, এ ডিগ্রি সরকারি প্রতিষ্ঠানে গ্রহণযোগ্য হবে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজে লাগবে। বিশেষ করে বিদেশে চাকরি বা স্কলারশিপের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। জাতিসংঘের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মিলবে আরও বিশেষ সুবিধা। এমফিল ডিগ্রির জন্য এখানে খরচ হবে এক লাখ ৬ হাজার টাকা। ভর্তির সময় দিতে হবে ২০ হাজার টাকা। এরপর প্রতি মাসে ছয় হাজার ৫০০ টাকা করে দিতে হবে। পিএইচডির মতো এমফিলেও প্রতি মাসে একটি করে সেমিনারে অংশ নিতে হবে। প্রথম ছয় মাস রিসার্চ মেথোডলজি ও জাতিসংঘ বিষয়ক ছয়টি সেমিনার হবে। তারপর রিসার্চে চলে যেতে হবে। প্রতি মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রেজেন্টেশন আকারে তৈরি করে জমা দিতে হবে।

পুরোটাই প্রতারণা : ৮ ও ৯ ডিসেম্বর দু’দিন বনশ্রীর আরমা কমপ্লেক্সে ‘ইন্টারন্যাশনাল কালচার ইউনিভার্সিটির (ভার্চুয়াল অ্যান্ড রিচার্স)’ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের বাইরে তাদের কোনো সাইনবোর্ড নেই। একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সাইনবোর্ড ঝুলছে। নির্মাণাধীন এ ভবনের তৃতীয় তলায় উঠতেই সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কয়েকজন লোক তেড়ে আসেন। তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস বন্ধ, পরে আসুন। পরে গিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে জানা যায়, কথিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান সুলতান মোহাম্মদ রাজ্জাক। বারবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়েকজন দোকানি জানান, ইন্টারন্যাশনাল কালচার ইউনিভার্সিটি নামের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা তারা কখনও শোনেননি। নির্মাণাধীন ওই ভবনে কিসের অফিস আছে তাও তারা জানেন না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, অবৈধ এ প্রতিষ্ঠানটি একই নামে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ ক্যাম্পাস হিসেবে উল্লেখ করে প্রতারণা করে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে অ্যাক্রিডিটেশন পাওয়া জাতিসংঘের একটি ব্র্যান্ডেড বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি পরিচালিত হচ্ছে বলে প্রচার করছেন। কয়েকটি সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে এ প্রতিষ্ঠানটি থেকে রাজধানীর একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রিন্সিপালও পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। এমফিল ডিগ্রি নিয়েছেন আরও দু’জন।

জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ইউনিভার্সিটিকে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা ভার্চুয়াল ইউনিভার্সিটি হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকে। ওয়েবসাইটে তারা অস্ট্রেলিয়ার একই নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ শাখা, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাক্রিডিটেশন অ্যান্ড রিকগনিশন কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়া (আইএআরসি) থেকে স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের ব্র্যান্ডেড ও গ্র্যান্টেড প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটটিকেও জাতিসংঘ, ইইউ, বাংলাদেশ সরকারসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের লোগো দিয়ে সাজানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া সনদেও আছে এসব প্রতিষ্ঠানের লোগো।

ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, ওপরেই রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের লোগো। এ ছাড়া আছে জাতিসংঘের গ্গ্নোবাল কমপ্যাক্ট, ইউনাইটেড নেশনস ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোসাল অ্যাফেয়ার্স, ইউনাইটেড নেশনস একাডেমিক ইমপ্যাক্ট, ইউনাইটেড নেশনস সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নলেজ প্ল্যাটফর্ম, এসআইএসএম নলেজ, ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নেটওয়ার্ক, ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অরগানাইজেশন, ইউনাইটেড নেশনস ডিকেইড অব এডুকেশন ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, ঢাকা সিটি করপোরেশন, গ্গ্নোবাল ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক ফর ইনোভেশন, ইইউ, এশিয়া প্যাসিফিক কোয়ালিটি নেটওয়ার্ক, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্টসের প্রতিষ্ঠানের লোগো।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002532958984375