চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজএমবিবিএস কোর্সে মেয়েরা, স্নাতকোত্তরে ছেলেরা এগিয়ে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ এমবিবিএস কোর্সে ২২০ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে ছাত্রী ১৩৯ এবং ছাত্র ৮১ জন। এই নিয়ে টানা তিনটি শিক্ষাবর্ষসহ গত পাঁচ বছরের মধ্যে চারটিতে ভর্তির পাশাপাশি মেধাতালিকা ও পাসের হারে ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে। শনিবার (১০ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন নূপুর দেব।

চমেক থেকে পাস করে চিকিৎসক হওয়া বর্তমানে বিভিন্ন বিভাগের নামকরা বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, এমবিবিএস কোর্সের শুরু থেকে দীর্ঘ কয়েক যুগ সরকারি এই মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ছাত্রসংখ্যা বেশি ছিল, শিক্ষাবর্ষগুলোতে প্রায় ৭০ শতাংশ ছাত্র এবং প্রায় ৩০ শতাংশ ছাত্রী ভর্তি হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ছেলেদের তুলনায় বেশি সংখ্যায় মেয়েরা ভর্তি হচ্ছে।

স্নাতক এই কোর্সে গত কয়েক বছরে মেধাতালিকায় আধিক্যসহ পাসের হারে ছাত্রীরা ভালো ফল করছে। তবে উচ্চতর পর্যায়ের (স্নাতকোত্তর) এমডি, এমএস, ডিপ্লোমাসহ বিভিন্ন কোর্সে ছাত্ররাই এগিয়ে রয়েছে।

জানা যায়, সর্বশেষ ১০ বছরে পাঁচ বছর মেয়াদের এমডি (ডক্টর অব মেডিসিন) ও এমএস (মাস্টার্স অব সার্জারি) কোর্সে নারী চিকিৎসকের চেয়ে পুরুষ চিকিৎসক বেশি ভর্তি হয়েছেন। সেই সঙ্গে ভালো ফলাফলের পাশাপাশি পাসের হারেও এগিয়ে রয়েছেন পুরুষ চিকিৎসকরা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৮টি বিষয়ে এমডি কোর্সে (সরকারি আসন) ভর্তি হওয়া ১৭৯ চিকিৎসকের মধ্যে পুরুষ ১৪৪ জন। একই (এমডি) কোর্সে (বেসরকারি আসন) ভর্তি ১৩০ জনের মধ্যে পুরুষ চিকিৎসক ৮৬ জন।

অন্যদিকে এমএস কোর্সে আটটি বিষয়ে সরকারি কোটায় ভর্তি হওয়া ১৩১ জনের মধ্যে ৯৭ জন পুরুষ চিকিৎসক। আর একই কোর্সে বেসরকারি কোটায় আটটি বিষয়ে ভর্তি হওয়া ১৯৪ জনের মধ্যে ১৪৩ জনই পুরুষ। তবে এমএসের আটটি বিষয়ের মধ্যে সাতটিতে পুরুষ চিকিৎসক ভর্তি বেশি হলেও গাইনি অ্যান্ড অব’স বিষয়ে কোনো পুরুষ চিকিৎসক ভর্তি হননি। শুধু এমএসের এই বিষয়েই ভর্তিকৃতরা সবাই নারী চিকিৎসক। সব মিলে এমএসের আটটি কোর্সের হিসাবে গড় ভর্তিতে পুরুষ চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি।

এ ছাড়া উচ্চতর ডিগ্রির দুই বছর মেয়াদের ডিপ্লোমা কোর্স ডিসিএইচ, ডিডিভি, ডি-কার্ড, ডি-অর্থো কোর্সের বিভিন্ন বিষয়ে পুরুষ চিকিৎসক বেশি ভর্তি হন। সব মিলে ডিপ্লোমা কোর্সগুলোতেও গাইনি অ্যান্ড অব’স বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে পুরুষ চিকিৎসকরাই বেশি ভর্তি হয়েছেন। সেই সঙ্গে পাসও বেশি পুরুষ চিকিৎসকের।

চমেক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, একসময় চমেকে এমবিবিএস ভর্তিতে ছেলেদের সংখ্যা বেশি হলেও তা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। প্রায় এক যুগ আগে ছাত্রীরা ছাত্রদের প্রায় সমান সংখ্যায় চলে আসে। পরে তা আরও বাড়তে শুরু করে।

জানা গেছে, নানামুখী সমস্যা ও বাস্তবতার মুখে পড়ে বিভিন্ন কারণে মেডিক্যাল শিক্ষায় ছেলেরা কম ভর্তি হচ্ছে। একইভাবে এমবিবিএসে ছাত্রীরা বেশি ভর্তির পাশাপাশি মেধাতালিকায়সহ পাসও বেশি করছে তারা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণে বিভিন্ন কোর্সে আবার নারী চিকিৎসকদের ভর্তি কম। এর প্রধান কারণ হচ্ছে মেয়েরা বিয়ের পর পারিবারিক কাজে সময় বেশি দেয়াসহ অন্যান্য কারণে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কম নিচ্ছেন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমাদের সময় এমবিবিএস কোর্সে যারা ভর্তি হয়েছিল তার মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ছিল মেয়ে। তা বাড়তে বাড়তে এখন দেখা যাচ্ছে, এমবিবিএস কোর্সে ছাত্রী বেশি এবং ছাত্র কম। কোন কারণে এমবিবিএস কোর্সে ছাত্র কমেছে তা পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।’

তিনি জানান, একজন চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সময় বেশি লাগে। দেখা যাচ্ছে এমবিবিএস (পাঁচ বছর), এরপর এক বছরের ইন্টার্ন এবং উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স (পাঁচ বছরের এমডি, এমএস) করতে কমপক্ষে গড়ে ১১ থেকে ১২ বছর সময় লেগে যায়। পড়ালেখায় দীর্ঘ সময় লাগা, পারিবারিক বিভিন্ন কারণে ছেলেরা এমবিবিএসে কম ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু অন্যদিকে নারী চিকিৎসক উচ্চতর ডিগ্রি কম নিচ্ছে। সেখানে (ওই কোর্সগুলোতে) আবার গড়ে পুরুষ চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি।

চমেক ও হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অব’স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সময় এই কলেজে এমবিবিএস কোর্সে বেশির ভাগ ছিল ছাত্র। এখন বিভিন্ন কারণে ছাত্রের সংখ্যা কমে আসছে মেডিক্যাল শিক্ষায়। স্নাতকোত্তর কোর্সে বিভিন্ন বিষয়ে আগের চেয়ে এখন নারী চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তবে প্রায় কোর্সে পুরুষ চিকিৎসক বেশি। পারিবারিক নানা সমস্যা ও চাকরিগত জটিলতায় নারী চিকিৎসকরা উচ্চতর ডিগ্রিতে কম আসছে বলে আমার মনে হচ্ছে।’

একই মেডিক্যাল ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সাবেক প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর হোসাইন ভূইয়া শাহীন বলেন, ‘আগে দীর্ঘদিন এমবিবিএস কোর্সে মেয়েরা গড়ে ২০-২৫ শতাংশ, কখনো ৩০ শতাংশ ভর্তি হয়েছিল। কিন্তুু ৮-৯ বছর ধরে ছাত্রী সংখ্যা বাড়ছে। এটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু ছেলেরা প্রকৌশল, স্থাপত্যসহ বিভিন্ন কোর্সে বেশি ভর্তি হচ্ছে। তারা মনে করছে, ডাক্তারি পেশার এলে সময় বেশি লাগবে, অন্য পেশায় গেলে মনে হয়, তারা আগেই শিক্ষাজীবন শেষ করে নিজেকে ঠিক সময়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।’

নাম প্রকাশ না করে চমেকে চর্মরোগ বিভাগের বিশেষজ্ঞ এক নারী চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের সময়ও ৩০ শতাংশের বেশি ছিল না ছাত্রী। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অনেকটাই উল্টো চিত্র। ছাত্রীসংখ্যা এমবিবিএসে অনেক বেড়েছে।’ নারীরা উচ্চশিক্ষায় কম যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমবিবিএসে ভর্তিতে যেভাবে ছাত্রী বেড়েছে, সেভাবে মেধাতালিকাসহ তারা পাসও করছে বেশি। তাহলে কেন তারা উচ্চতর ডিগ্রি কম নিচ্ছে? এর প্রধান সমস্যা হলো এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হওয়ার পর দেখা যায়, অনেকের (নারী চিকিৎসক) বিয়ে হচ্ছে যাচ্ছে। তখন তারা পারিবারিক কাজসহ বিভিন্ন কারণে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হতে পারছে না। আবার অনেকেই মনে করছে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করলেও তো সরকারি পর্যায়ে থাকলে পদোন্নতি হলে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন হাসপাতালে পদায়ন হবে। এই কারণেও একটু অনীহা।

চমেক সূত্রে জানা যায়, এমবিবিএস কোর্সে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া ১৯৬ জনের মধ্যে ১১৫ জনই ছাত্রী। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ১৯৭ জনের মধ্যে ১০৪ জন ছাত্রী। এর আগের শিক্ষাবর্ষে (২০১৫-১৬) ছাত্র বেশি ছিল। এই শিক্ষাবর্ষে মোট ভর্তীকৃত ১৯৭ জনের মধ্যে ১১৩ জন ছাত্র ছিল। এ ছাড়া ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ১৯৭ জনের মধ্যে ১০২ জন নারী এবং ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ১৯৬ জনের মধ্যে ১১৬ জন ছাত্রী ভর্তি হয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070412158966064