আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমানের ৯২তম জন্মদিন আজ। বাঙালি জাতির নানা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের অসংগতি ও শোষণের বিরুদ্ধে তার অগ্নিদীপ্ত পঙ্ক্তিমালা বাংলা কবিতায় নির্মাণ করেছে অনন্য কাব্যস্বর। শামসুর রাহমানকে নাগরিক কবি বলা হলেও গণমানুষের সঙ্গে আধুনিক বাংলা কবিতার আত্মীয়তা সৃষ্টিতে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য।
জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ তথা পঞ্চাশের দশকে তিনি আধুনিক কবি হিসেবে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হন। অল্প সময়ের ভেতরেই দুই বাংলায় পরিচিতি লাভ করেন।
শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকার মাহুৎটুলীর নানাবাড়িতে। শামসুর রাহমানের ডাকনাম ছিল বাচ্চু। বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে। পুরান ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন কবি- তাই নগরজীবনের নানা অনুষঙ্গ ও উপকরণ বিচিত্র আঙ্গিকে উঠে আসতে দেখা যায় তার কবিতায়। ষাটের দশকের শুরুর দিকেই তার প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত হতে থাকে কবিতার ভুবন। "উনিশ শ' ঊনপঞ্চাশ" শিরোনামে রচনার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে পদচিহ্ন আঁকেন বাংলা কবিতার আঙিনায়। এটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। আধুনিক কবিতার অনন্য পৃষ্ঠপোষক বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকায় তার 'রূপালি স্নান' কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে শামসুর রাহমান সুধীজনের দৃষ্টিলাভ করেন।
শামসুর রাহমান পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। ১৯৫৭ সালে দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ সহসম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে একে একে রেডিও পাকিস্তান, দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা ইত্যাদিতে কাজ করেছেন।
শামসুর রাহমান বাংলা কাব্যে সব সময় নাগরিকতার ধারক। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' (১৯৬০)। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, ব্যর্থতা, শোভাহীনতা, নৈঃসঙ্গ শামসুর রাহমান সেলাই করে দিয়েছেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের অনেক স্তবকে। তার কবিতার বিষয়বস্তু ছিল প্রেম, মানবিকতা, স্বাধীনতা, ভাষা। অসাম্প্রদায়িকতা আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার পঙ্ক্তিমালা উচ্চকিত হয়েছে সব সময়। বাংলাদেশের ভাষাসংগ্রাম, স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে তার কবিতা ছিল অনুপ্রেরণা। নব্বইয়ের স্বৈরাচারী আন্দোলনের সময়ও শামসুর রাহমানের কলম থেমে থাকেনি।
'নিজ বাসভূমে', 'বন্দী শিবির থেকে', 'দুঃসময়ে মুখোমুখি', 'ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা', 'বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে', 'ইকারুশের আকাশ', 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ', 'যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে', 'অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই', 'দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে', 'বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়', 'ভস্মস্তূপে গোলাপের হাসি' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের শিরোনামই কবির স্বদেশ চিন্তার অন্যতম দলিল।
'স্বাধীনতা তুমি', 'বন্দী শিবির থেকে', 'বর্ণমালা', 'আমার দুঃখিনী বর্ণমালা', 'তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা', 'আসাদের শার্ট', 'ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯'- কবিতাগুলো তার স্বাধীনতাকামী মনের পরিচয় বহন করে।
বাংলা কবিতার আধুনিকতম কবি শামসুর রাহমান। দেশমাতৃকার জন্য যার কবিতা স্লোগানে, ব্যানারে, দেয়াললিখনে এমনকি মুখে মুখে ব্যবহার হয়েছে অহরহ।
কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শামসুর রাহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ভারতের রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি দেওয়া হয়।
এদিকে, কবির জন্মদিন সামনে রেখে গতকাল বিকেলে বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ ও শামসুর রাহমান স্মৃতিপরিষদের যৌথ উদ্যোগে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একটি আলোচনা সভা ও নিবেদিত কবিতাপাঠের আয়োজন করা হয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সভাপতিত্বে আলোচনা ও স্মৃতিচারণায় অংশ নেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, কবি আসলাম সানী, ড. জালাল ফিরোজ, কবি পিয়াস মজিদ। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির উপপরিচালক কবি আমিনুর রহমান সুলতান।
এ ছাড়া সারাদেশে আজ সাহিত্যিক, সাহিত্যানুরাগী ও বিভিন্ন সংগঠন কবির জন্মদিন উদযাপনে নানা আয়োজন করেছে।