করোনা গবেষণা ও আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গতকাল আমার ছোটভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ভাইয়া তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) করোনাভাইরাস প্রতিরোধের ওষুধ আবিষ্কার করতে পারে না? করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষকের প্রস্তাবিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখার পর সে আমাকে এমন প্রশ্নই করল। পাশেই থাকা আমার এক আংকেল বলল, সবাই নাকি বিসিএস ক্যাডার হতে চায়, সরকারি চাকরির জন্য লাইব্রেরিতে নাকি সবাই একাডেমিক বই না পড়ে বিসিএসের বই পড়ে, গবেষণা নাকি খুব একটা হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। এর একদিন আগে আমার আরেকটা ফ্রেন্ড বলল, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরাই নাকি গবেষণায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসলেই কি পিছিয়ে পড়ছে? তাদের আমি আমার মতো করে যেই উত্তরগুলো দিলাম সেটাকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরতে চাই। বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখানে ভর্তি পরীক্ষায় সফল হয়েই ভর্তি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এরা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য যে মেধা, ধৈর্য এবং পরিশ্রমটুকু করে সে রকম মেধা, ধৈর্য বা পরিশ্রম যদি এরা গবেষণাই করত তাহলে আমাদের দেশের সার্বিক অবস্থাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণা ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া বা পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর চাইতেও অনেক দূর এগিয়ে যেত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীই ভর্তি হওয়ার চার-পাঁচ বছর পর হয়ে যায় বিসিএস ক্যান্ডিডেট। এদের অধিকাংশই বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদসহ সরকারি নানা পদে চাকরির জন্য চেষ্টা করে এবং সফলও হয়। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে প্রায় সত্তর-আশি ভাগের মত বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ বা নিজে কিছু করার জন্য চেষ্টা করে। তবে সেই সংখ্যাটা খুবই নগন্য। বিজ্ঞানধর্মী হওয়া সত্বেও গবেষণার কথা শোনলেই এদের আগে পেটের কথা মনে পড়ে। মনে করে গবেষণার চাইতে চাকরিটাই জরুরি এবং সেটাই আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্যই বাস্তব সত্য কথা। এই ক্ষেত্রে আমাদের সিস্টেম এবং কর্মমুখী শিক্ষার অভাব টাকেই আমি দায়ী করব। এর মধ্য থেকেও কেউ কেউ শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় হয়ে ওঠেন বিশ্বমানের গবেষক যারা পরবর্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাজ করেন, হয়ে যায় বড় মানের গবেষক ও প্রফেসর।

একজন অনার্স বা মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্র বা ছাত্রী আসলে গবেষণা করে না, সে আসলে শিক্ষকদের বা সুপারভাইজারদের গবেষণা দেখে দেখে শিখতে থাকে এবং এক সময় পরিপক্ব হয়। ততদিনে সে আর ছাত্র থাকে না। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা মূলত শিক্ষকরাই করবেন বা তারা ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে করিয়ে নিবেন এটাই প্রচলিত নিয়ম বলে মনে করি। শিক্ষকদের গবেষণার জন্য সরকারের বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বিভিন্ন রকম অনুদানের ব্যবস্থাও আছে। যদিও সেটা অনেক কম বা শিক্ষদের চাহিদা মত নয়। কিন্তু যেটুকুই অনুদান দিয়ে থাকেন সেটারও কতটুকু বাস্তাবায়ন হয় সেটা নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা শুনেছি।

আরেক শ্রেণীর গবেষণা হয়ে থাকে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে যেমন পিএইচডি বা এমফিল ডিগ্রির জন্য। গবেষণা করাই তাদের সিলেবাস। যদিও ফুল সিস্টেমটা এখনও সুসংগঠিত নয়। গবেষণার জন্য সরকারের উদ্যোগ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডাস্ট্রিগুলো সমন্বিত হতে পারেনি। তবে দিন দিন এর ধারাবাহিকতা পরিবর্তন হচ্ছে। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব ভালোভাবেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা আশাকরি আমাদের দেশেও একদিন উন্নত বিশ্বের মতো গবেষণা হবে। করোনাভাইরাসের মতো রোগগুলোকে আমরাও প্রতিহত করার জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কার করব। এটা এখন শুধু সময়ের ব্যপার।

আমার ছোট ভাই আমাকে আবার বলল, তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা কেমন করে এটা সেটা করে, রোবট বানায়, মাঝে মাঝে ফেসবুকে নিউজে পাই। এবার আমি তাকে মূল কথাগুলো শোনালাম।

আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী আসে মধ্যবিত্ত বা কেউ কেউ আসে নিম্নবিত্ত পরিবার হতে। আবাসিক হলে থাকা প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীরা টিউশনি বা বিভিন্ন কোচিংয়ে ক্লাস নিতে হয়। পড়ালেখার বাইরেও এদের অনেক সময় দিতে হয়। ছাত্র থাকাকালীন সময়েই অনেককেই পারিবারিক হাল ধরতে হয়, আমি নিজে আমার ফ্যামিলি সাপোর্ট দিয়েছি এবং অনেকই দেখেছি ফ্যামিলির খরচ বহন করতে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি, ব্যক্তিগত ব্যস্ততা এবং গবেষণামুখী না হয়ে অন্যান্য বিষয়ের প্রতি আগ্রহ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষককে বলতে শোনেছি- ‘এখানকার অনেক শিক্ষকরাই রাজনীতিটাকে ফরজে আইন বানিয়ে ফেলেছেন, ঢাকার অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পার্ট টাইম পরিশ্রমের বিনিময়ে, শিক্ষকরা অনেকক্ষেত্রে ল্যাবমুখী না হয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হয়। গবেষনার মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা না করে দলীকরণসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য দায়িত্বগুলোই যেন উনাদেরকে বেশি টানে। তবে এর বিপরীত চরিত্রের শিক্ষকও আছেন যারা ছাত্রছাত্রীদের সত্যিই গবেষণাসহ নৈথিক শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলেন। যদিও এই সংখ্যাটা আমার কাছে খুব কম। আমার মতে শিক্ষক রাজনীতি এবং দলীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের অভিশাপটাই মূলত শিক্ষা এবং গবেষণার পরিবেশটাই নষ্ট করে দিচ্ছে।’

উপরে উল্লিখিত কোন সমস্যাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সাধারণত পড়ে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রাজনীতি, গ্রুপিং বা দলীয়করণ নেই বলে শিক্ষার পরিবেশটা ব্যাহত হয় না। কোন শিক্ষকের ক্লাস ভালো না লাগলে, মানহীন, গবেষণাধর্মী না হলে বা ভুল পড়ালে সেটার জন্য ছাত্রছাত্রীরা মতামত দিতে পারে যেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আকাস কুসুম চিন্তার মতো।

আমার মতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাংকিং আরো সামনের দিকে থাকা উচিত, সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের গবেষণামুখী করে তোলা তুলনামূলক সহজ, কারণ তারা বিসিএসের প্রতি তেমন মাথা ঘামায় না। ওদের আপনি যেভাবে খাওয়াতে চাইবেন সেভাবে সহজে গিলতে পারে। এই গুনটা আসলেই ইতিবাচক দিক। উন্নত বিশ্বের অনেক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান র‌্যাংকিংয়ের দিক দিয়ে প্রথম দিকে আছে। তবে আমাদের দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসায়িক চিন্তা আরেকটু কমিয়ে দিয়ে আরেকটু মানসম্মত ছাত্রছাত্রী ভর্তি করালে তারা হয়ত আরো এগিয়ে যাবে। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত।

আমার ছোটভাই আমাকে আবারো প্রশ্ন করল, আচ্ছা ভাইয়া সবই বুঝলাম তবে করোনাভাইরাসের প্রতিকার নিয়ে তোমাদের দায়িত্বটাই সব থেকে বেশি; কারণ তোমরা ফার্মেসি নিয়ে পড়াশোনা করেছ। ওষুধ আবিষ্কার বা এটার শনাক্তকারী কিট যা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন তা নিয়ে হলেও কিছু একটা করা উচিত।

আমি বললাম, করোনাভাইরাসে সংক্রমণ রোধের জন্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে অঘোষিত লকডাউন চলছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো সিদ্ধান্ত। তবে সরকার আমাদের বিদ্যমান স্কলার বা গবেষক যারা দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ করে মলিকিউলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, জিন প্রকৌশল, ফার্মেসি বা বায়োলজিক্যাল ফ্যাকাল্টির হাই প্রোফাইলের গবেষকদের নিয়ে জাতীয়ভাবে কোন কমিটি গঠন করেন নাই। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা আমাদের যে রিসোর্সগুলো আছে সেই রিসোর্সগুলোও সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছি না। দেশে অনেক গবেষনা কেন্দ্র এবং এতগুলা বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলা ল্যাব রয়েছে, কিছু কিছু উন্নতমানের ল্যাবও আছে, সে গুলোতে ছোট পরিসরে হলেও করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারত বা সরকার চাইলে এখনো সম্ভব। এক্ষেত্রে আমাদের প্রবাসী বিজ্ঞানীরা তো আছেনই, তারাও আমাদের সাহায্য করতে পারত।

আচ্ছা ভাইয়া, শুধু করোনাভাইরাসের শনাক্তকরণ করেই কি লাভ? উওরে আমি বললাম, গত এক মাস যাবত শুধু সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরেই শুধু শনাক্তকরণের পরীক্ষা হতো। তাও অপ্রতুল এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগও ছিল। সম্প্রতি আরো কয়েকটি ল্যাব স্থাপনের কাজসহ এবং শনাক্তকরণের কাজও শুরু হয়ে গেছে। অনেক ডাক্তারই সাধারণ রোগীদেরও চিকিৎসা দিতে ভয় পায় শুধু করোনা আতঙ্কে। শনাক্ত করা গেলে কমপক্ষে এ সমস্যাটা হবে না। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপই হলো এর শনাক্তকরণ এবং রোগী পজিটিভ হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেশন করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিতে হবে।

আসলে আমাদের অনেক ঘাটতি আছে, আবার অনেক সমস্যাও আছে। তবে তাই বলে আমাদের কিছুই করার নেই এমন নয়। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে ক্রান্তিলগ্নে জাতির জনকের ভাষণই হতে পারে আমাদের শিক্ষা- ‘আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ আমাদের যে জ্ঞান এবং সম্পদ আছে তা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলেও আমরা অনেক কিছুই করতে পারব। এই অদৃশ্য যুদ্ধে আমাদের জয়ের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

লেখক : মো. জামাল হোসেন, ফার্মাসিস্ট।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.026664972305298