করোনা নিয়ে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে রাজধানীতে ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, ‘মুসলমানদের জন্য করোনাভাইরাস কোন আতঙ্কের কারণ নয়, বরং কাফিরদের প্রতি চরম আযাব-গজব’ এই শিরোনামের লিফলেট বিতরণের সময় শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে এবং মৌচাক থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় আটকদের কাছ থেকে লিফলেট ও তাদের বহনকারী একটি পিকআপ ভ্যান (ঢাকা মেট্রো-ম, ৫১-২৫৯০) জব্দ করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, করোনা সংক্রমণ নিয়ে বিভ্রান্তিকর লিফলেট বিতরণের খবরটি উদ্বেগজনক। আশার কথা, পুলিশ ওই দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছে। আমাদের দাবি থাকবে, অবিলম্বে ওই দুষ্টচক্রের হোতাদের খুঁজে বের করা হোক এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হোক।
এটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যের যে, দলমত নির্বিশেষে সারা বিশ্বের মানুষ যখন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে একযোগ লড়াই করছেন, তখনও কিছু ধান্দাবাজ ধর্ম ব্যবসায়ী উসকানিমূলক লিফলেট বিলি করে সমাজে বিভ্রান্তি ও অশান্তি সৃষ্টি করছে। বিদ্বেষমূলক প্রচারণার কাজটি যে শুধু লিফলেট বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে তা নয়। বরং প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে নানা রকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ওয়াজ এবং ফেসবুক ও ইউটিউবকেও ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এটা করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই চলছে। এসব প্রচারণা নিশ্চিতভাবেই জনমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ও ছোঁয়াচে রোগ বিস্তারের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। প্রচারণাকারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন, জাতীয় দুর্যোগের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছেন। বিভ্রান্তিকর এমন অসংখ্য ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুললেও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কোন উদ্যোগ নেই। সরকারি কোন তদারকিও চোখে পড়ছে না। এর বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনরকম পদক্ষেপও নেয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো শুরু থেকেই নিষ্ক্রিয় থেকেছে। করোনা নিয়ে গুজব ছড়ানোর ঘটনায় জেল-জরিমানা দেয়া হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় উসকানি, বিভ্রান্তি ছাড়ানোর কারণে কেউ আইনের আওতায় আসছে না। এতে করোনা নিয়ে মৌলবাদীদের গুজব ও বিভ্রান্তিসহ সাম্প্রদায়িক উসকানি থামছে না। সরকার এদের প্রতি কেন এত নমনীয় সেটাই প্রশ্ন?
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় ও করণীয় সম্পর্কে অনেক ভুল পরামর্শ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্করভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে ধর্মীয় অপব্যাখ্যাগুলো। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ কেউ বলছেন, করোনাভাইরাস আতঙ্কে মাস্কের পেছনে না ঘুরে, মুসলমানরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুন, মহান আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে বিপদমুক্ত রাখবেন। কেউ কেউ করোনাভাইরাসের দোয়া দিচ্ছেন, কেউ বলছেন, স্বপ্নে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক পেয়েছেন এবং শুধু মুসলমানদেরই এটি দেয়া হবে। এ ধরনের ধর্মীয় বক্তব্যসমূহ মানুষকে ভুলভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। যার ফলে সমুদ্র সৈকত ও অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্রসহ বাজারে, মসজিদে, দোকানে কোথাও জনসেচেতনতার আশানুরূপ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে অনেকে এসব ভুল ওয়াজ ও ব্যাখ্যা শুনে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, তারা ভাবছেন এ ভাইরাস মুসলমানদের কোন ক্ষতি করবে না। এটা অমুসলিমদের শায়েস্তা করার জন্য আল্লাহর দেয়া গজব।
বস্তুত এসব প্রচারণার উদ্দেশ হচ্ছে, সংকটময় মুহূর্তে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ধর্ম ব্যবসাকে প্রশস্ত করা। এর পেছনে মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, জঙ্গি সংগঠন এমনকি সন্ত্রাসী জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে থাকতে পারে।
ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিষয়ে আপসকামিতা কখনই দেশের জন্য কল্যাণকর হবে না। মৌলবাদীদের বিভ্রান্তি বন্ধের দায়িত্ব নিতে হবে বিটিআরসি আর সরকারকে। এ সংকটকালে ধর্ম নিয়ে যদি কেউ বিভ্রান্তি ছড়ায় তাদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, শুধু ধর্ম দিয়ে যদি সব ঠেকানো যেত তাহলে তো আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রয়োজন হতো না। এসব বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিরুদ্ধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এখনই সর্বোচ্চ এবং সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসবে।