করোনার প্রভাবে উচ্চশিক্ষায় ফিরছে সেশনজট

নিজস্ব প্রতিবেদক |

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০৯ সালের আগে প্রতিষ্ঠানভেদে সেশনজট ছিল এক থেকে তিন বছরের। কিন্তু ২০১৭ সালের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তা দূর করা সম্ভব হয়। এমনকি সেশনজটের শীর্ষে থাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দূর করে সেশনজট। যদিও প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু করোনার ছোবলে উচ্চশিক্ষা আবারও সেই সেশনজটের ফাঁদে পড়তে চলেছে।
করোনাভাইরাসের ছোবলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েক মাস টানা বন্ধ থাকায় এবং আবাসিক হলগুলো খালি করে দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা সবাই বর্তমানে যার যার বাড়িতে রয়েছেন। গত আগস্ট থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও আটকে গেছে শত শত পরীক্ষা। এখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে কোর্স পড়ানো শেষ করে পরীক্ষা নেওয়া শুরু করলেও অন্তত এক বছরের সেশনজটে পড়তে হবে শিক্ষার্থীদের। কভিড-১৯-এর সংক্রমণ প্রথমবারের মতো সেশনজট সৃষ্টি করেছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও। কবে নাগাদ আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো নেওয়া শুরু করা যাবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে জানা গেছে, দেশে ৪৬টি সরকারি এবং ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়েছেন বিপাকে। দেশের উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী ৪১ লাখের ওপর। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন লাখ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার লাখ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮ লাখ, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ লাখ এবং ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আরও এক লাখ ছাত্রছাত্রী পড়ছেন। করোনায় বিভিন্ন বর্ষের সেমিস্টার, ইনকোর্স ও বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। বিশেষ করে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের সংকট বেশি। নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শেষ হলে তারা এতদিনে চাকরির বাজারে ঢুকে যেতেন। কিন্তু কভিড তাদের জীবনে ঘোর অমানিশা হয়ে দেখা দিয়েছে।


সরকারের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস শুরু করা হলেও প্রত্যন্ত এলাকায় থাকা অন্তত ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কোনো ইন্টারনেট সুবিধা নেই। অনলাইনে ক্লাস করতে অনীহা রয়েছে ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর। পড়ালেখার বাইরে রয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ লাখ শিক্ষার্থীও। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কোনো কোনো কলেজে নামমাত্র অনলাইন ক্লাস চললেও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা তাতে খুবই কম। আরও পিছিয়ে পড়ছেন উন্মুক্ত ও আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।
গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত এই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। 

এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির ইস্যুও সামনে চলে এসেছে। সম্প্রতি ইউজিসির অনলাইন সভায় উপাচার্যরা জানিয়েছেন, একাডেমিক পরীক্ষা শেষ করে পুরোনোদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। নইলে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার ফলে সংকট আরও তীব্র হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটের আশঙ্কায় ১৭ অক্টোবর উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভায় অনলাইনে একাডেমিক পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মুনাজ আহমেদ নূরের নেতৃত্বে তৈরি করা একটি সফটওয়্যার নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনাও হয়েছে।
বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই বছরে তিনটি সেমিস্টার। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্প্রিং, মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত সামার এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফল সেমিস্টার। স্প্রিং সেমিস্টারের মাঝামাঝিতে এসে শুরু হয় করোনাকাল। ফলে বাকি কোর্স তারা অনলাইনে সম্পন্ন করে পরীক্ষাও নেয়। ক্লাস করুক আর না করুক অথবা যা-ই শিখুক না কেন, তাদের সবাইকেই পরবর্তী সেমিস্টারে উন্নীত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এতে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র :গড়পড়তা এক হিসাবে দেখা গেছে, কভিডের ছোবলে দেশের ৪৬ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কোর্সের শুধুমাত্র পরীক্ষাই স্থগিত হয়েছে ২০ থেকে ২২ হাজার।

সারাদেশের দুই হাজারের বেশি কলেজের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও সৃষ্টি হয়েছে একাডেমিক সংকট। এখানে চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা গত মার্চেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। বেশিরভাগ পরীক্ষাও দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। দুই থেকে পাঁচটি বিষয়ের পরীক্ষা আটকে যায় করোনার কারণে। সেই থেকে হাত গুটিয়ে তারা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাস কোর্স দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ এবং মাস্টার্স ফাইনাল এপ্রিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনা সংক্রমণের কারণে এসব পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে যায়। ডিগ্রি পাস কোর্সে প্রতিটি বর্ষে ৩৪টি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। গত আগস্ট পর্যন্ত মাস্টার্স প্রিলিমিনারি, অনার্স প্রথম বর্ষ পরীক্ষাও হওয়ার কথা ছিল। প্রতিটি বর্ষের ৩১টি বিষয়ে পরীক্ষা ছিল। করোনার কারণে এই পুরো পরীক্ষাসূচিই এলোমেলো হয়ে গেছে। চাকরির বয়স পেরিয়ে যাওয়ায় দুর্ভাবনায় পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা।
উপাচার্যরা যা বলেন :সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক এই সংকটকে মেনে নিতে হবে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে দিন কাটানো যাবে না। দুর্দিনের কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে সহজেই সংকট কাটানো যাবে। আটকে যাওয়া পরীক্ষাগুলোর কথাও ভাবা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য 'এডুকেশন বাবল' করা যেতে পারে। এডুকেশন বাবলের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার পুরো পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা যেতে পারে। তিনি জানান, কভিড-পরবর্তী সময়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলার একটি রূপরেখা তারা ইতোমধ্যেই প্রণয়ন করেছেন।
 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034189224243164