করোনার প্রভাবে চরম হতাশায় ভুগছেন চাকরিপ্রার্থীরা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গত মার্চ মাস থেকেই একে একে স্থগিত হয়েছে বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা। এই সময়ে সরকারি-বেসরকারি নতুন কোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি নেই বললেই চলে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আগামী দিনে কর্মসংস্থানের সুযোগ আগের চেয়ে কমবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। ফলে চাকরিপ্রার্থীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।  প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও চাকরির বাজার আগের জায়গায় ফিরবে না। কারণ করোনা কমসংখ্যক লোক দিয়ে বেশি কাজ করা শিখিয়ে গেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে যাঁরা তথ্য-প্রযুক্তিসহ নানা কাজে দক্ষ এবং যেকোনো ধরনের কাজ করার মানসিকতা রয়েছে, তাঁদের আগামী দিনে চাকরি পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।

চাকরির বাজার নিয়ে সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে চাকরির বাজারে ধস নেমেছে। চাকরির বিজ্ঞাপন ব্যাপকভাবে কমেছে। গত বছরের মার্চের তুলনায় এ বছরের মার্চে চাকরির বিজ্ঞাপন ৩৫ শতাংশ কম ছিল। গত এপ্রিলে কমেছে ৮৭ শতাংশ। এপ্রিলে পোশাক ও শিক্ষা খাতে ৯৫ শতাংশ কম চাকরির বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। উত্পাদনমুখী শিল্পে ৯২ শতাংশ কম চাকরির বিজ্ঞাপন এসেছে। স্বাস্থ্য খাতে চাকরি কমেছে ৮১ শতাংশ। তথ্য-প্রযুক্তিকে আগামী দিনের সম্ভাবনা হিসেবে ধরা হলেও সেখানে চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ৮২ শতাংশ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ৬৪ শতাংশ।

দেশের চাকরির বড় ওয়েব পোর্টাল বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী এ কে এম ফাহিম মাশরুর  বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় বিডিজবসে এপ্রিলে প্রায় ৮০ শতাংশ, মে মাসে ৭০ শতাংশ ও জুন মাসে ৫০ শতাংশ চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে। ২০২০ সালটা খুব বেশি ভালো যাবে না বলেই মনে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই নতুন নিয়োগ তো দিচ্ছেই না; বরং লোকবল কমাচ্ছে। ফলে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সুযোগটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

আগামী দিনের চাকরির বাজারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী সময়ে ই-কমার্স, লজিস্টিক, অ্যাগ্রিকালচার, ফুড প্রডাকশনের মতো কম্পানিতে চাকরির সুযোগ বাড়বে। তবে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিতরাই বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছেন। সবাই এসি রুমে টেবিলে বসে চাকরি করতে চান। ব্যাংক বা সরকারি চাকরিতে প্রার্থীদের আগ্রহ থাকলেও সেখানে পদ খুবই কম। আগামী দিনে চাকরি করতে হলে উচ্চশিক্ষিতদের দক্ষতার সঙ্গে মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে পারলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।’

জানা যায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত চার মাসে সরকারি ও বেসরকারি বড় প্রতিষ্ঠানের শতাধিক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন সেন্টারের (ব্যান্সডক) সায়েন্টিফিক অফিসার ও অ্যাকাউন্টস অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল গত ২০ মার্চ। ৩৫ পদের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৫০ হাজার। একই দিনে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১১ ক্যাটাগরির মোট ৪৫ পদের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৩৫ হাজার। খাদ্য অধিদপ্তরের এক হাজার ১০০ পদের জন্য আবেদনকারী ছিলেন ১৫ লাখ। মার্চ-এপ্রিলে এ পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা ছিল। দুদকের বিভিন্ন পদের পরীক্ষাও আটকে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বিভিন্ন পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তা স্থগিত করা হয়েছে। একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগও করোনায় আটকে আছে। গত ১৫ ও ১৬ মের ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা স্থগিত করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। এতে ১১ লাখ ৭২ হাজার প্রার্থী চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন।

করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) দুটি বিসিএস ও ১০টি নন-ক্যাডারসহ মোট ১২টি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এসব পরীক্ষার আয়োজনের সুযোগ নেই।

তবে করোনার মধ্যেও ৩৮তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। এই বিসিএসে উত্তীর্ণদের থেকে নন-ক্যাডার পদের জন্য আবেদন গ্রহণও শুরু হয়েছে। এ ছাড়া দুই হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ হাজার সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হলেও করোনার কারণে ফল প্রকাশ স্থগিত রয়েছে। ফলে অপেক্ষায় আছেন ২০ হাজারের বেশি প্রার্থী। ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা এ বছরের এপ্রিলের শেষে হওয়ার কথা ছিল। এতে অংশ নিতে আবেদন করেছেন চার লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থী।

পিএসসি চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক  বলেন, ‘সারা দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে আমাদের পরীক্ষা নিতে হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে করোনার মধ্যেও আমাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যেসব ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব সেগুলো আমরা করে যাচ্ছি।’

আগে চাকরিপ্রার্থীরা সব সময় নজর রাখতেন সংবাদপত্র ও বিভিন্ন চাকরির ওয়েব পোর্টালে। গত চার মাসে সেখানে নতুন কোনো সরকারি বা বেসরকারি বড় চাকরির বিজ্ঞপ্তি ছিল না। সংবাদপত্রে সবচেয়ে বেশি চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেয় ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু গত কয়েক মাসে এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি ছিল হাতে গোনা।

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিজিত সিকদার  বলেন, ‘এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট থাকে। এরপর আবার করোনায় চাকরির পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। নতুন বিজ্ঞাপন নেই। ফলে অনেকেরই চাকরির বয়স ৩০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দাবি, আগামী তিন বছরের জন্য হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার।’

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার ২৩ লাখ ৭৭ হাজার এবং অশিক্ষিত বেকার তিন লাখ। বেকারদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত, যাঁরা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। উচ্চশিক্ষা পর্বের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করা বেকারের সংখ্যা চার লাখ পাঁচ হাজার। যদিও বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরো বেশি।

ইউজিসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরসহ সমমানের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা সাত লাখ ১৪৮ জন। আর ১০৩ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উত্তীর্ণের সংখ্যা ৬৮ হাজার ৭২৯ জন।

মূলত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নেন প্রার্থীরা। সেই হিসাবে প্রতিবছর চাকরিতে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করেন উচ্চশিক্ষিত প্রায় সাড়ে সাত লাখ প্রার্থী। চলতি বছর যদি সমসংখ্যক প্রার্থী চাকরিতে না ঢুকতে পারেন তাহলে বছর শেষে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সব পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ফাইনাল, মাস্টার্স ফাইনাল, ডিগ্রি দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ এবং মাস্টার্স প্রিলিমিনারি পরীক্ষা আটকে গেছে। ফলে অনেকেই পড়ালেখা শেষ করে চাকরির প্রত্যাশায় থাকলেও চূড়ান্ত পরীক্ষাই শেষ করতে পারছেন না। এতে শিক্ষার্থীদের সেশনজটে পড়তে হবে। তাঁদের মধ্যেও হতাশা বাড়ছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0054171085357666