প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—করোনার আগে দেশের সব পর্যায়ের পাঠদানই ছিল শ্রেণীকক্ষনির্ভর। করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর শিক্ষা-শ্রেণীকক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় পাঠদান চালিয়ে নিতে দূরশিক্ষণ পদ্ধতি চালু করে সরকার। এতেও শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছা সম্ভব হচ্ছে না।সোমবার (২৪ আগস্ট) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, আবার অনুকূল পরিবেশ না থাকায় বাড়িতেও এগোচ্ছে না পড়ালেখা। দীর্ঘ ছুটি ও আর্থিক দুরবস্থার কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ঝুঁকিও বেড়েছে বহুগুণ। শিক্ষকদের অবস্থাও ভালো নয়। বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না বেসরকারি খাতের হাজারো শিক্ষক। অনেকেই শিক্ষকতার চাকরি হারিয়ে এখন বেকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ও পাবলিক পরীক্ষা নিয়েও দ্বিধায় নীতিনির্ধারকরা। সব মিলিয়ে করোনায় বিপর্যস্ত দেশের গোটা শিক্ষা খাত।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ, মেয়েদের শিক্ষামুখী করা, ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনাসহ শিক্ষা খাতে বেশকিছু লক্ষ্য অর্জন হয়েছিল। যদিও কভিডের আঘাতে সেসব অর্জন হারাতে বসেছে। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বড় বিনিয়োগে শিক্ষা খাতের পুনরুদ্ধার সম্ভব।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী এ প্রসঙ্গেবলেন, কয়েক বছর ধরে গুণগত মানসহ শিক্ষার বিভিন্ন সংকট নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এখন করোনার প্রভাবে সে সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। শিক্ষার সংকট এখন বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটি একটি বড় শূন্যতা তৈরি করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছা সম্ভব হচ্ছে না। তবে শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে শিক্ষার জন্য সরকারের কোনো প্রণোদনা নেই। তাহলে ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে কীভাবে?
তিনি আরো বলেন, করোনার প্রভাবে শিক্ষা খাতে বড় বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। আর্থিক দৈন্যদশায় অনেকেই সরকারের উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে না। কারণ যেসব ডিভাইসের মাধ্যমে পাঠদান দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এ সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। এছাড়া অনলাইন শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে, তবে সরকার এখনো ইন্টারনেট থেকে ভ্যাট নিচ্ছে। এগুলো সাংঘর্ষিক।
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ১৬ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। করোনা পরিস্থিতি অবনতির কারণে এ ছুটি আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। দীর্ঘ ছুটিতে সিলেবাস এগিয়ে নিতে টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে পাঠদান সম্প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। যদিও শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই দূরশিক্ষণ পদ্ধতির এ পাঠদান থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশনের ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারে না। সংস্থাটি ৬ হাজার ১৫৩ জন শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখান থেকে সংসদ টেলিভিশনের কাভারেজের আওতায় আছে এমন ২ হাজার ৪০৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ৬৫৬ জন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের বিস্তারিত সাক্ষাত্কার নেয়া হয়। আর কোনো টিভি চ্যানেলই দেখার সুযোগ নেই বাকি ৩ হাজার ৭৪৫ জন শিক্ষার্থীর। ফলে সংসদ টেলিভিশনের ক্লাসে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত। সরকারি শিক্ষাসহায়তা পাওয়া এসব শিক্ষার্থীর মাত্র ১৫ শতাংশ ইন্টারনেট সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। এছাড়া অন্য গ্রুপে ৯০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫২৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মাত্র ১০ শতাংশ ইন্টারনেট পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত।
ঢাকার সানারপাড় এলাকার একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে কাউসার মাহমুদ। বাসায় টিভি না থাকায় সম্প্রচারিত কোনো ক্লাসই করতে পারেনি এ শিক্ষার্থী। তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম জানান, টিভি কেনার সামর্থ্য নেই তার। তাই বিদ্যালয় বন্ধের পর থেকে বই নিয়ে বসা হয়নি তার সন্তানের। স্কুল বন্ধ থাকায় কয়েক মাস নানার বাড়িতে বেড়িয়ে এসেছে। পড়ায় না বসা এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে বহুগুণ। বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রথম ধাপ হলো শ্রেণীকক্ষে অনুপস্থিতি। আর ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ দরিদ্রতা। করোনার ছুটিতে একদিকে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় ধরে শ্রেণীকক্ষের বাইরে থাকছে, অন্যদিকে কর্মের সুযোগ না থাকায় আয় বন্ধ হয়েছে হাজারো পরিবারের। তাই করোনার এ দীর্ঘ ছুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন: অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট ২০১৯’ (এএসপিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের ১৮ দশমিক ৬ শতাংশই পঞ্চম শ্রেণী শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার প্রথম শ্রেণীতে ১ দশমিক ৯ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২ দশমিক ৭, তৃতীয় শ্রেণীতে ৩ দশমিক ৪, চতুর্থ শ্রেণীতে ৮ দশমিক ৪ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিকে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রকাশিতব্য শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩। এর মধ্যে ছাত্রী ৫৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মাধ্যমিকে এসব শিক্ষার্থীর ৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশই দশম শ্রেণী শেষ করার আগে ঝরে পড়ে।
করোনার এ বন্ধে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা করছেন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাও। এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, আমি যে উপজেলায় কর্মরত এখানে এমনিতেই আর্থিক সংকটের কারণে পরিবারগুলো তাদের সন্তানকে ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে পাঠায়। করোনার এ সংকটে এখানকার জনগোষ্ঠীর অভাব আরো বেড়েছে। এজন্য তারা সন্তানদের বাধ্য হয়েই কাজে পাঠাচ্ছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ কাউন্সেলিং করার চেষ্টা করছি। শিক্ষকদেরও পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ইন্টারনেট ও ডিভাইস সুবিধার অভাবে অনলাইন পাঠদান থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন নেই। এছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ ও ডেটা ক্রয়ের সক্ষমতার অভাবে ডিভাইস থাকাদের অনেকেই অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।
করোনায় দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)। সম্প্রতি এক পলিসি ব্রিফের মাধ্যমে সংস্থাটি জানিয়েছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৩ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে মেয়ে ২ কোটি ২১ লাখ ৫ হাজার ৫৮৯ এবং ছেলে ১ কোটি ৯৭ লাখ ২১ হাজার ২৫৪ জন। যার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ৮২৫ জন, প্রাথমিকে ৮৭ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩ জন, মাধ্যমিকে ৮৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৬ জন এবং ১২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৫ জন উচ্চশিক্ষায়। এছাড়া ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এদিকে নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে পরীক্ষা সিলেবাস অসম্পূর্ণ রেখে কোনো ধরনের মূল্যায়ন ছাড়াই অটো প্রমোশনের কথা বলা হচ্ছে। যদিও শিক্ষাবিদরা বলছেন, সিলেবাস অসম্পন্ন রেখে অটো আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে শিক্ষায় বড় শূন্যতা তৈরি হবে। দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষাব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রেণীভিত্তিক বইগুলোর সঙ্গে একটি শ্রেণীর সঙ্গে আরেকটি শ্রেণীর সম্পর্ক রয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী গণিত বইয়ের কোনো অধ্যায়ে অদক্ষ থেকে গেলে সপ্তম শ্রেণীতে গিয়েও গণিত বুঝতে তার সমস্যা হবে। তাই অটো প্রমোশনের যে চিন্তা করা হচ্ছে, সেটি দূরদর্শী কোনো পদক্ষেপ হবে না। প্রয়োজনে শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়িয়ে সিলেবাস শেষ করে পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন দেয়াই মঙ্গলজনক। প্রয়োজনে পরীক্ষা নেয়ার দরকার। কিন্তু পাঠ্যবই শেষ করতে হবে।
এদিকে করোনার বন্ধে আয় না থাকায় শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর লক্ষ্মীপুর শহরের একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন হেলাল উদ্দিন। শিক্ষকতা থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে চলত বাবা-মায়ের সংসার। হঠাৎ মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করায় বেকার হয়ে পড়েন তিনি। জীবনের তাগিদে শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে তিনি বর্তমানে একজন কৃষক। শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে পতিত জমিতে ধানের চাষ, শাকসবজির চাষসহ গবাদি পশু পালন করেন। বর্তমানে কৃষিকাজে উপর্জিত আয়েই বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে চলে তার সংসার।