কলেজ সরকারি, শিক্ষক বেসরকারি!

মো. আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন |

কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি করেন?’ উত্তরে বলি, ‘আমি কলেজে চাকরি করি।’ কোন কলেজে চাকরি করেন জানতে চাইলে উত্তর দিতে পারি না। কি বলবো? এবিসি ডিগ্রি কলেজ, না এবিসি সরকারি কলেজ? যেহেতু সব কাগজপত্র ও সাইনবোর্ড ব্যানারে কলেজের নাম সরকারি কলেজ, তাই আর ডিগ্রি বলা যায় না। কিন্তু সরকারি কলেজ বলতে লজ্জা লাগে। কারণ আমার গায়ের রংচটা পোষাক, পায়ে ছেড়া জুতা আর মলিন মুখ নিয়ে যদি বলি- আমি সরকারি কলেজের প্রভাষক তাহলে আমাকে পাগল ভাবতে পারে।

সরকারি কলেজের একজন প্রভাষক কমপক্ষে ৩৩ হাজার টাকা বেতন-ভাতা পান। তার গায়ে রংচটা জামা, পায়ে ছেড়া জুতা থাকার কথা না। তারা তো বুঝবে না আমরা সরকারি কলেজের বে-সরকারি অনার্স শিক্ষক। যারা এমপিও পাই না, সরকারি বেতন ও পাই না। পাই সম্মানী। আর যে সম্মানী পাই তা যদি প্রকাশ করি তা হলে সম্মান শ্রেণির শিক্ষক হয়ে আমাদের সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।

আগে মাসে ৪ হাজার টাকা বেতন পেতাম, সরকারি হওয়ার পর আর পাই না। কবে পাবো জানি না! আর কাউকে যদি বোঝাতে চাই যে, আমরা অনার্স শিক্ষক এখনো সরকারি বিল পাই না, তবে আমাদের সরকারি বিল হবে; তখন তারা স্পষ্ট বলে দেয়- ‘অনার্স সরকারি হবে না, শুধু ইন্টার ও ডিগ্রি সরকারি হবে’। এই সব কথা বলতে, শুনতে, শোনাতে খুব লজ্জা লাগে। তাই এখন পরিচয় দেই আমি কিছু করি না, বেকার। তাহলে আর লজ্জায়ও পড়তে হয় না, আবার অপমানিতও হতে হয় না। আর কেউ এই লেখার মানে না বুঝলেও সরকারিকৃত অনার্স শিক্ষক এই কথার মানে অবশ্যই বুঝবেন।

সারা বিশ্ব আজ করোনা ভাইরাসের কারণে ভীত। বন্ধ হয়ে গেছে পৃথিবীর গতিশীলতা। বিশ্বের মহা শক্তিধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানরা আজ চিন্তিত। কি হবে আগামী দিনগুলোতে? কিন্তু আমার মনে করোনা ভাইরাসের কোনো আতঙ্ক নেই। বাকি সবাই যখন করোনা ভাইরাস নিয়ে আলোচনা করে, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভাবে, তখন আমি চিন্তা করি আমার সরকারিকরণ কবে হবে? পদসৃজন হবে তো? গত তিন বছরের ধার দেনা পরিশোধ করতে পারবো তো? শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মাউশি অধিদপ্তর আমাদের কথা মনে রাখবে তো? আত্মীয় স্বজনদের বলতে পারবো তো যে, ‘আমার বেতন হয়ে গেছে’।

যদি ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর ‘না’ হয় তাহলে বেচেঁ থেকে কি হবে? এর চেয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরে গেলেই ভালো হবে। ভাবনার মধ্যে কত পার্থক্য? সারা পৃথিবী কী ভাবে, আর আমি কি ভাবি? আমার বয়সী সকল বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী যখন সংসারের হাল ধরেছে তখন আমি চেয়ে আছি সরকারিকরণ হলে আমিও সংসারের হাল ধরবো এই আশায়। বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াবো। 

করোনা আতঙ্কে আমার বন্ধুরা (যারা চাকরিজীবী অথবা অন্য যে কোনো পেশার সাথে জড়িত) যখন বাড়ির জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য চাল, ডাল, তেল আটা ময়দা ইত্যাদি কিনে বাড়িতে মজুদ করছে, যেন ১৫-২০ দিন ঘর থেকে বের হতে না হয়। তখন আমি ভাবছি পদসৃজন হলে আমিও কিনতে পারতাম। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে চাকরিতে যোগদান করেছি। আজ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ। প্রায় ৬ বছর এই আশায় ১২টা ঈদ পার করেছি, ৬ টা ১লা বৈশাখ পালন করেছি। আশা পূরণ হয়নি।

কলেজ সরকারিকরণ না হয়ে যদি বে-সরকারি থাকতো তা হলে অনার্স শিক্ষক হিসেবে প্রতি বছর ১ হাজার টাকা করে বৃদ্ধি পেয়ে এখন বেতন হতো প্রায় ১১ হাজার টাকা। তাতে হয়তো এই বিপদের দিনগুলোতে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারতাম। ২ কেজি তেল, ২ কেজি চিনি, এক কেজি ডাল, ১ কেজি পেয়াজ, ২০ কেজি চাল, ৫ কেজি আলু কিনে রাখতাম। কিন্তু সরকারিকরণ হওয়ার পর থেকে বেতন বন্ধ।  সরকারিকরণ হওয়ার আগে স্বপ্ন ছিল- বেতন প্রতি বছর ১ হাজার টাকা করে বাড়বে। শুরুতে ৬ হাজার টাকা, বছর বছর ১ হাজার করে বাড়লে ৫ বছর পর হবে ১১ হাজার। ১০ বছর পর হবে ১৬ হাজার। যেটা অন্যান্য বেরকারি অনার্স কলেজে হয়ে থাকে। (বি.দ্র.: আমার জানামতে অনেক বেসরকারি কলেজে অনার্স শিক্ষক ২০ হাজার টাকাও বেতন পেয়ে থাকেন।) তখন স্বপ্ন  ছিল ছোট, আশা ছিল কম। তাই অনার্স শিক্ষক হিসেবে কলেজে যোগদানের পর ভালোই লাগছিল । কিন্তু ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে সরকারিকরণের ঘোষণা এবং ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে জিও জারি সব স্বপ্ন, আশা শেষ করে দিলো।

সরকারি কলেজ, সরকার বেতন দেবে, কলেজ থেকে বেতন বন্ধ। সরকারিকরণ হওয়ার কারণে কমিটি না থাকায় বলতে গেলে আমাদের দেখার কেউ নেই। বেতন নেই সে কথা বলতে গেলেও বিপদ। শাখেঁর করাত যাকে বলে আরকি। 

জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা পদাধিকার বলে সরকারিকৃত কলেজের সভাপতি। কিন্তু শত ব্যস্ততার কারণে আমাদের খবর নিতে পারেন না। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তাই মাননীয় সকল জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়ের নিকট আবেদন, আপনারা দয়া করে সরকারিকৃত অনার্স শিক্ষকদের একটু খোঁজ-খবর নেবেন। আমাদের দেখার কেউ নেই। করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে পারছি না। আপনারা নিজ নিজ এলাকার সরকারিকৃত কলেজের অনার্স ও নন-এমপিও শিক্ষকদের একটু খোঁজ নেবেন। কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা মানবতার মা দেশরত্ন শেখ হাসিনা এই দায়িত্ব আপনাদেরকে অর্পণ করেছেন।

লেখক : মো. আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন, প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান, আদিতমারী সরকারি কলেজ, আদিতমারী, লালমনিরহাট।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068759918212891